বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারির মতে, আমরা নতুন একটি সভ্যতার সূচনাকালে আছি। আমাদের মধ্য দিয়েই আগের সভ্যতার শেষ হলো। সময়টা এখন এমন যে রাজনীতি, পরিবেশ, মতবাদ, উদ্ভাবন, এমনকি মানুষও আর কোনো দেশ বা সীমানার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। পরিবর্তনের জোয়ার বিশ্বজুড়ে চলছে। মানুষ এক বিশাল গ্লোবাল ‘সিটিজেন’ বা বৈশ্বিক নাগরিকতার অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো ঘটনা এখন আর কোনো দেশের একার ঘটনা নয়, তার একটা বৈশ্বিক প্রভাব থাকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ সবকিছু এখন বৈশ্বিক ব্যাপার। এমন অবস্থায় আমেরিকার ‘আমেরিকান ড্রিম’ কতটা প্রাসঙ্গিক, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর কতটা উন্নয়ন বয়ে আনবে, তা–ও প্রশ্নসাপেক্ষ।
সময়টা এমন যখন মানুষ আর আগের মতো না খেয়ে মরে না, বেশি খাওয়ার কারণে মরে। মহামারিতে মরে না, বার্ধক্যজনিত কারণে মরে। বিশ্বজুড়ে জঙ্গি বা অপরাধকর্মে যত মানুষ মারা যায়, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ মরে আত্মহত্যায়। অর্থাৎ মানুষ এখন নিজেই নিজের জন্য সবচেয়ে বড় ভীতির কারণ। মানুষে মানুষে সন্দেহ ও অবিশ্বাস এতটাই বাড়ছে যে তা দেশ থেকে দেশান্তর, জাতি থেকে জনগণ, এমনকি ঘরে ঘরে, মাথায় মাথায় ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভাবন একদিকে যেমন দূরত্ব কমিয়ে আনছে পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থার গতি বাড়িয়ে, তেমনি মানুষের মাঝে দূরত্বও বাড়াচ্ছে।
সময়টা এখন এমন যে উন্নয়নের চকচকে মোড়কের লোভ দেখিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে এক অস্থির বাজার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছে, যেখানে মানুষ আর মানুষের সঙ্গে সময় কাটায় না। এই প্রতিযোগিতায় সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। কাউকে ছাড় দিলে যেনবা পিছিয়ে পড়বে এই ভয় সবার মনে। শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে বাজার উপযোগী জনসম্পদ তৈরি করার কারখানায় পরিণত হয়েছে। যেখানে ব্যবসা করবে চীন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে আমেরিকা-ইউরোপ, ক্রেতা হবে তেল উৎপাদনকারী ‘ধনী’ রাষ্ট্র, আর বাজার উৎপাদনে শ্রম দেবে বাংলাদেশ, ভারত, কেনিয়া, ঘানাসহ এশিয়া ও আফ্রিকার সব ‘গরিব’ জনগণ। বিশ্বজুড়ে এই শ্রম ও সম্পদের শ্রেণি বিভাজন বজায় রাখতে দরকার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম।
সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার যে কৌশল উদ্ভাবন করেছে মানুষ, সময়ের আগে চলার যে ব্রত নিয়ে বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর দেশ ইতিহাস তৈরি করছে, তার মূল চালিকাশক্তি বিশ্বের সাধারণ জনগণ। মানুষের যে সহজাত প্রবৃত্তি, সৃষ্টিকুলের প্রাণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, তা সময়কে জয় করার এই অকৃত্রিম প্রক্রিয়া দ্বারা বাধাগ্রস্ত। এই দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত মানুষ ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে আশ্রয় পায় তার স্মার্টফোনে। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, কষ্ট, ক্রোধ, বিদ্বেষ, প্রতিশোধ, ভালোবাসা সবকিছু প্রকাশের জায়গা ফোন। আর এইভাবেই মানুষের সম্পর্ক দিন দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের’ বা এআই এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
আমরা কোথায় যাই, কখন যাই, কীভাবে যাই, কী খাই, কী পরি, কোথা থেকে কিনি, কোথায় বেড়াতে যাই, কোন হোটেলে থাকি, কী পছন্দ করি বা কী করি না, কত টাকা খরচ করি, কত টাকা জমা আছে, এমনকি কোন অনুভুতিতে কী ধরনের গান শুনি, ভিডিও দেখি বা খবর পড়ি এসব তথ্য আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে জানিয়ে রাখছি। এভাবে এই অশরীরী এআই আমাদের সব কৃতকর্মের হিসাব নিয়ে রাখছে। আর এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে ঘড়ি, বাড়ি, শাড়ি, গয়না, প্লেনের টিকিট, হোটেলে বা দোকানে ছাড়, গান, বন্ধু, কাজ বা শখের খবরাখবর দিয়ে যাচ্ছে। এর অবশ্য সুফল ও কুফল দুটোই আছে। সুফল হলো নিজের কাজের কিছু সুবিধা হয়, যা চাইছি তাড়াতাড়ি পেয়ে যাচ্ছি। আর কুফলটা হলো বেশ গভীর। এআই অনুভূতিহীন এক ব্যবস্থা, যে কেবল শূন্য ও এক, অর্থাৎ কম্পিউটারের ভাষা বোঝে। বিখ্যাত প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি উদ্ভাবক ইলন মস্ক এআইকে বলেন ‘বোতল ভূত’। তাঁর মতে, জিনি বোতল থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, এখন একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যথার্থ শিক্ষা, বিবেচনা ও সচেতনতা দিয়ে এই এআইকে নিজের কাজে ব্যবহার করা যেতেই পারে, তবে মনে রাখতে হবে এআই ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করে না। বাজারের স্বার্থে কাজ করে। আমেরিকান হুইসলব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেন বারবার করে বলে যাচ্ছেন, কীভাবে ফোনগুলো আমাদের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ‘ডেটা’ হিসেবে।
আমরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছি। যদিও সব সময়ই তা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়টা এমন যে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে প্রযুক্তি, আমাদের সব সময়ের সাথি, এআই। প্রযুক্তির রাজনৈতিক ব্যবহারের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের প্রতিনিধি মাঠপর্যায়ে কাজ করবে, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রকাশ করবে এবং জনস্বার্থে কাজ করবে। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষের চাওয়া পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দগুলো সম্পর্কে সহজেই তথ্য পাওয়া যায় এআই দ্বারা সংগৃহীত এইসব ডেটার ভিত্তিতে। জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে এসব হিসাব কষে ট্রাম্প ভোট জিতে সমালোচিত হলেও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট তিনি বনে গিয়েছেন।
সময়টা এখন এমন যে গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। দার্শনিক, রাজনৈতিক সমালোচক নম চমস্কি বলেন, গণমাধ্যম হলো বাজার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম সহায়ক, যারা কিনা সমাজের ‘এলিট’। সরকার থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ ও ‘উচ্চস্তরের’ সবার সঙ্গেই তাদের চলাফেরা। দিন শেষে এই গণমাধ্যমগুলো হলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রাজনীতি ও সমাজের মতোই তারাও সমানভাবে বিরোধপূর্ণ ও বিভাজিত। বিশ্বে কোথায় কী হচ্ছে বা কোন খবরকে কীভাবে মানুষের কাছে পরিবেশন করা হবে, তা নির্ধারণ করেন তাঁরা। এরাই একবার ওসামা বিন লাদেনকে হিরো বানিয়ে দিল, আবার রাজনৈতিক স্বার্থে জঙ্গি বানিয়ে দিল। এরাই মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে জনক্রোধ তৈরি করে ইরাক আক্রমণে পশ্চিমাদের জনসমর্থন এনে দিল। এরা ইরাক আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য বারাক ওবামাকে নায়ক বানিয়ে দিল, অথচ তার নির্দেশে সবচেয়ে বেশি পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন হামলা হয়েছে, প্রচুর বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়েছে, সে খবরগুলো চেপে গেল। অদূর ভবিষ্যতে ওবামা আবারও শান্তিতে নোবেল পেলে মানুষ হয়তো তা উদযাপনও করবে। কারণ, আমরা সাধারণ মানুষ এখন ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি এআই দ্বারা। আর গণমাধ্যমের বিক্রি করা ভয়ের রাজনীতিতে ভীত হয়ে অবিশ্বাস করছি নিজের কাছের মানুষজনকেই। যার ফলে পৃথিবীজুড়ে আত্মহনন বেড়ে গিয়েছে।
সময়টা এখন এমন যে নতুন প্রজন্ম এখন আর নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস করছে না। নিজেরাই রাস্তায় নেমে পরছে তাদের দাবি আদায়ে। বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমরা ‘শিশু আন্দোলন’ দেখেছি, পরিবেশবাদী ১৩ বছরের গ্রেটার সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেখেছি। ৩৪ বছরের তরুণী সানা মারিন ফিনল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস তৈরি করেছে—যিনি দুই মায়ের পরিবারে বড় হয়েছেন। গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ইতিহাসে এই প্রথম কোনো শান্তিতে নোবেল বিজয়ীকে জবাবদিহি করতে দেখেছি। যদিও এমন ঐতিহাসিক ঘটনা জনস্বার্থে সুফল বয়ে আনতে পারেনি। এই সময়ে রোবটের সুনিপুণ কর্মদক্ষতা মানুষের জীবিকার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষ ও রোবটের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। চীন দেশে নিজ রোবটকে বিয়ে করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে মনে করেন ২০৪০ সালের মধ্যে রোবটের সঙ্গে বিবাহ বৈধতা পাবে।
পরিশেষে বলি, নভেম্বরের শেষে নেপালে গিয়েছিলাম ‘মধ্য এশিয়া-দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্ক’ নিয়ে একটি আলোচনায় অংশ নিতে। সেখানে এই দুই অঞ্চলসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন তাঁদের বক্তব্য পেশ করতে। চীনের প্রতিনিধিদের উপস্থাপনার সময় দেখা যায় যে চীনের মানচিত্রে চীন তার দাবি করা অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারতের মানচিত্রে কাশ্মীর অন্তর্ভুক্ত না করা এখন আইনগত অপরাধ। রাশিয়ারও দাবি রয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর। এমন পরিস্থিতি যেখানে বিশ্বের মানচিত্র বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন দেশের মানুষ কী তাহলে তার নিজ নিজ দেশের তৈরি বিশ্ব মানচিত্র ব্যবহার করবে, নাকি অদূর ভবিষ্যতে আমরা সীমানাবিহীন একটি বিশ্ব মানচিত্র দেখতে পাব! এমন একটি পৃথিবী হবে যেখানে মানুষ অবাধে চলাচল করতে পারবে যে কোনো জায়গায়।
বছর শেষে ভারতে চলমান নাগরিক আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসেছেন সব ধর্মের তরুণ। এই আন্দোলন উল্লেখযোগ্য কারণ এটি একদিক থেকে বিশ্বায়ন ও জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব। ভারতের তরুণ সমাজ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিচিত হতে চায় না। তারা ন্যায়ের পথে এগোতে চায়, তারা বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকতে চায়। এমন দাবি করার ক্ষমতা সব দেশের সব জনগণের আছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ লেখার অধিকার একমাত্র জনগণের, সরকারের কাজ করার কথা জনপ্রতিনিধি হিসেবে। বিশ্বজুড়ে শাসকেরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভয়ের রাজনীতি শুরু করেছে, তাতে তারা জনগণের সব তথ্য নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। অথচ যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণ সব ক্ষমতার অধিকারী, সেখানে সব তথ্যের মালিক জনগণ আর সরকারকে নজরদারিতে রাখার কথা জনগণের।
বর্তমান সময়ে যেখানে কোনো ঘটনা এখন আর কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয় এবং জনগণ দিন দিন সোচ্চার হচ্ছে তাদের অধিকারের ব্যাপারে। আমরা কি একটা একক বৈশ্বিক শাসনব্যাবস্থার দিকে এগিয়ে চলছি? নাকি কোনো স্থানীয় সমাধান খুঁজছি? এই আন্দোলনে একটি প্ল্যাকার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, যেখানে লেখা আছে—
‘কিসের বর্ডার, কিসের কাঁটাতার
বিশ্বজুড়ে থাকবে মানুষ, পৃথিবীটা জনতার’
এই নতুন সভ্যতার সূচনালগ্নে, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে, একটা নতুন ন্যায্য বিশ্ব গড়ার প্রতীক্ষায় শুরু হোক একটি নতুন বছর।
আইরিন খান: লেখক ও গবেষক