নতুন শিক্ষাক্রম চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক

একদিকে ২০২৩ সালে আমাদের দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে, আর অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করার জন্যই হয়তো এ শিক্ষাক্রম। কিন্তু আদতে বিষয়টি তা নয়।

গত শতকজুড়ে পৃথিবীব্যাপী যে হিউম্যানিস্ট মুভমেন্ট জোরদার হয়েছে, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমটি আসলে তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া। যেমন আমরা যদি রাজনীতির কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখব, সেখানে সাধারণ মানুষ কী অনুভব করে, সেটাই মুখ্য। যেমন তারা যদি মনে করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন, তো তিনিই হবেন; তাঁর যোগ্যতা থাক বা না থাক, তাতে কিছু আসে-যায় না।

এখনকার শিক্ষায় পাঠ্যবই বা শিক্ষকদের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষার্থী নিজে। তার চিন্তাভাবনা, চাওয়া-পাওয়া বা আবেগ-অনুভূতিটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার শেখার চেয়েও তার শিখতে শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এখনকার শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে একজন শিক্ষার্থী যেন নিজের পছন্দে ও নিজের চেষ্টায় শিখতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে।

একইভাবে আমরা যদি অর্থনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, সেখানে ভোক্তারা কী পছন্দ করছে, সেটাই আসল। ভোক্তারা পছন্দ না করলে একটা পণ্যের যত গুণই থাকুক, তার কোনো দাম নেই। আমরা যদি নন্দনতত্ত্বের দিকে তাকাই, সেখানেও একই কথা। সৌন্দর্যের কোনো বিশ্বজনীন সংজ্ঞা নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—আপনার চেতনার রঙেই পান্না সবুজ কিংবা চুনি রাঙা হয়। এ কারণেই কথায় আছে, সৌন্দর্য থাকে আপনার চোখে, বস্তুতে নয়।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও তা-ই। এখনকার শিক্ষায় পাঠ্যবই বা শিক্ষকদের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষার্থী নিজে। তার চিন্তাভাবনা, চাওয়া-পাওয়া বা আবেগ-অনুভূতিটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার শেখার চেয়েও তার শিখতে শেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এখনকার শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে একজন শিক্ষার্থী যেন নিজের পছন্দে ও নিজের চেষ্টায় শিখতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে।

কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এলে আপনার এসব চিন্তাভাবনা বা আবেগ-অনুভূতিগুলোও এক অর্থে মূল্যহীন হয়ে যাবে। কারণ, এগুলো আর আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। আরও যে কারণে আপনার মন খারাপ হবে, সেটা হলো যাকে আপনি আপনার চিন্তা বা আবেগ বলে ভাবছেন, আপনি তখন দেখবেন, সেগুলো আসলে আপনার শরীরে সংঘটিত বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদম। ইউভাল নোয়াহ হারারি এ প্রসঙ্গে একটি বেবুনের উদাহরণ দিয়েছেন। ধরা যাক, একটা বেবুন একটা কলাগাছে ঝুলন্ত কলা দেখে সেগুলো খাওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখল, একটু দূরে একটা সিংহ বসে আছে। এখন সে কলা খাবে না দৌড়ে পালাবে, সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সময় তাকে স্বাধীন মনে হলেও হারারি বলছেন, আসলে সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যেটাকে তার স্বাধীন ইচ্ছাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়, সেটা আসলে তার বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদমের বহিঃপ্রকাশ।

বেবুনটি আসলে মুহূর্তের মধ্যে অনেকগুলো উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ফেলে, যেমন কলার সংখ্যা, সেগুলো পাকা না কাঁচা, সিংহটা কত দূরে, সে বসে না দাঁড়িয়ে, ক্ষুধার্ত না ক্ষুধার্ত নয়, তার নিজের পালানোর পথ কোনটা বা সে কত জোরে দৌড়াতে পারবে ইত্যাদি। কিন্তু এটা তো সে আর একজন গবেষকের মতো পেপার, পেনসিল বা ক্যালকুলেটর দিয়ে করে না, সে করে তার পুরো শরীর দিয়ে, মূলত তার ইন্দ্রিয়, নার্ভাস সিস্টেম ও মস্তিষ্ক দিয়ে। তবে অন্য সব বিশ্লেষণের মতো এই বিশ্লেষণের ফলাফল সংখ্যা দিয়ে প্রকাশিত হয় না, প্রকাশিত হয় আবেগ বা অনুভূতির মধ্য দিয়ে। যেমন বেবুনটা যদি ভয় পায়, ওই ভয় আসলে তার বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদমেরই ফল। মানুষের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য।

এত দিন বিজ্ঞানের পক্ষে মানুষের ভেতরের এই বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদমকে বোঝা সম্ভব ছিল না। এখন বোঝে। শুধু তা-ই নয়, এখন সে সেটাকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। ফলে এত দিন হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের প্রভাবে অর্থনীতি, রাজনীতি বা শিক্ষা যেভাবে চলেছে, সেভাবে আর চলবে না।

যেমন প্রকাশনাশিল্পের কথা ধরা যাক। এত দিন সেটা পাঠকের পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কারণ, পাঠকের পছন্দ-অপছন্দকে সে যে শুধু পাঠকের চাইতেও ভালো বুঝতে পারবে তা নয়, তাকে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে। যেমন আপনি যদি আমাজনে ঢুকে কোনো বই পড়েন, তাহলে যন্ত্র ঠিকই বুঝতে পারবে কোন জায়গায় আপনি বেশি সময় নিচ্ছেন বা কোন জায়গায় আপনি দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছেন। আপনি কিন্ডেলে বই পড়লে, আপনি বইকে যতটা পড়বেন, বই আপনাকে তার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে ফেলবে। আপনার যন্ত্রের যদি ফেস রিকগনিশনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে আপনি বইয়ের কোন জায়গায় হাসছেন বা কাঁদছেন, তার কিছুই যন্ত্রের অজানা থাকবে না। আর যদি বায়োমেট্রিক সেন্সর দিয়ে যন্ত্রের সঙ্গে আপনার শরীরকে যুক্ত করা যায়, তাহলে আপনার আবেগ-অনুভূতিগুলোকে আপনি যতটুকু বোঝেন, তার চেয়েও অনেক ভালোভাবে বুঝবে আপনার যন্ত্র এবং তা যখন হবে, তখন আপনি কী পড়তে চান, সেটা আপনি আর নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন না, জিজ্ঞাসা করবেন যন্ত্রকে। যন্ত্র যে বই পড়তে বলবে, আপনি সেটাই পড়বেন। যন্ত্র যাকে ভালোবাসতে বা ভোট দিতে বলবে, আপনি তাকেই ভালোবাসবেন বা ভোট দেবেন। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদমকে আপনার চেয়ে ভালো বুঝবে।

বোঝাই যাচ্ছে, হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টের অভিঘাতে শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে আমরা যে নতুন শিক্ষাক্রম সামনের বছর থেকে বাস্তবায়ন করতে চলেছি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এসে গেলে সেটা আর তেমন প্রাসঙ্গিক থাকবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এলে কী ধরনের শিক্ষাক্রম প্রয়োজন হবে, সে সম্পর্কে এখনো কোনো স্পষ্ট ধারণা কোথাও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যে সেদিকে কিছুটা অগ্রসর হতে পারব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি আমাদের নিজেদের বায়োকেমিক্যাল অ্যালগরিদমকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সুবিধা হবে। তা না হলে তার দাস হয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশির সাবেক মহাপরিচালক, অধ্যাপক ও ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ