শিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে

বিদ্যালয় শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রমের খসড়া ঘোষিত হয়েছে। কিছু বিচার–বিবেচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০২২ সাল থেকে এই শিক্ষাক্রম প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত চালু হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন। এই শিক্ষাক্রমের কিছু নতুন দিক শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এগুলোকে ইতিবাচক পরিবর্তন বলেই দেখা হচ্ছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল হবে। দশম শ্রেণির পর (এসএসসি সমতুল্য) হবে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রম ধারাবাহিকতা মেনে সামগ্রিকভাবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন ধারায় শিক্ষার্থীদের বিভাজন একাদশ শ্রেণি থেকে হবে (বর্তমানে নবম শ্রেণির পরিবর্তে) অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী একই মূল শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠ নেবে। জ্ঞান ও দক্ষতার লক্ষ্যের সঙ্গে মূল্যবোধ আহরণ ও চরিত্র গঠন শিক্ষার্থীর অর্জিতব্য যোগ্যতার উপাদান হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসচেতন নাগরিকদের আলোচনায় ও প্রত্যাশায় এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে এসবের স্বীকৃতি তাঁরা সমর্থন করবেন।

সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল–মে বাংলাদেশের আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্যোগমুক্ত ও নাতিশীতোষ্ণ। বর্তমানে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ষশেষের পরীক্ষা ও বর্ষশুরুর আয়োজনে আসল পড়াশোনা বিশেষ হয় না। সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাবছর শুরু হলে মে–জুন পর্যন্ত অবিরাম শিক্ষার কাজ চালিয়ে জুনে বর্ষশেষ পরীক্ষা নেওয়া যায়। জুলাই–আগস্টে হতে পারে বার্ষিক ছুটি

যে ক্ষেত্রে আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে তা হলো, একটি ভালো দলিল তৈরি করা সংস্কারের প্রথম ধাপ মাত্র। এটি কাজে লাগানোর সক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও সদিচ্ছা কতখানি আছে, সেটি বড় প্রশ্ন। ২০১২ সালে প্রবর্তিত শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর অর্জনযোগ্য যেসব লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল, তা অর্জনের কৌশল ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকদের যথার্থ প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়েনি। শিক্ষার অনেকগুলো প্রধান বিষয় যেমন গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক সংখ্যা ছিল অপর্যাপ্ত। শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সাযুজ্য না থাকলেও পাবলিক পরীক্ষার চাপ প্রকৃত শিক্ষণ–শিখন বাধাগ্রস্ত করেছে। শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক নির্দেশিকা যথাসময়ে তৈরি ও বিতরণ করে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়নি।

এসব ব্যর্থতা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, জবাবদিহির রীতি ও কর্মকর্তাদের নিষ্ঠা ও আচরণে নানা রকম ব্যত্যয় মেনে নেওয়ার সংস্কৃতির কারণে চলে এসেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে একটি ভালো নতুন শিক্ষাক্রম দলিল তৈরি হলেই বা কী লাভ হবে?

বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাক্রমের সনাতনী তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক কিছু জ্ঞান ও কিছু দক্ষতার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য। উচ্চাভিলাষী নতুন শিক্ষাক্রমে যোগ হয়েছে বিশ্লেষণী ও যুক্তিশীল চিন্তাভাবনাসহ সৃজনশীলতার প্রকাশ এবং সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা। আরও আছে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ আহরণ ও চারিত্রিক গুণাবলি গঠন ও চর্চা, যা দিয়ে শিক্ষার্থীর অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই হবে। লক্ষ্য নিঃসন্দেহে মহৎ। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার যে দুর্বলতায় বর্তমান শিক্ষাক্রমের অপেক্ষাকৃত সীমিত অভীষ্ট অর্জিত হয়নি, সেই অন্তরায়গুলো কীভাবে দূর হবে? শিক্ষাক্রমের খসড়ায় এক ‘মহাবাস্তবায়ন পরিকল্পনার’ কথা বলা হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনার উপাদান ও কৌশল কী হবে এবং বর্তমানে সর্বব্যাপ্ত অদক্ষতা ও দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের কৌশল কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। দুটি বড় মাপের বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে—শিক্ষক এবং সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনা। এই দুই ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য মাথায় রেখে স্বল্পমেয়াদি ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষকের সংখ্যা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও যথার্থ নিষ্ঠার অভাব নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও জরুরি তিনটি পদক্ষেপ হবে:

১. প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা যাচাই করে (মাধ্যমিক স্তরে বিষয় অনুযায়ী) যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

২. নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অনুযায়ী পাঠদান ও শিক্ষার্থী মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে এক ধারাবাহিক ও নিবিড় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও জেলা–উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা এই কাজে যুক্ত হবেন।

৩. প্রতি পাঠের বিষয়ের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরি করে সব শিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং এগুলো শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা। অনলাইনেও এসব সামগ্রীর বিস্তরণ হতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হবে মেধাবী ও আদর্শবান তরুণদের শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রস্তুত করা, নিয়োগ দেওয়া ও ধরে রাখার জন্য অন্তত দশসালা সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ। এ বিষয়ে ভিন্ন আলোচনা প্রয়োজন।

সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো সহজ সমাধান নেই। শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চতম নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দক্ষ ও যোগ্য লোককে দায়িত্ব দেওয়াএবং তাঁদের কাজের স্বীকৃতিদান একটি জরুরি পদক্ষেপ। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে হতে হবে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী ও দায়বদ্ধতার উদাহরণ। একটি প্রথম কাজ হবে প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সহপ্রধানদের শূন্য পদগুলো অনতিবিলম্বে পূরণ করা। শিক্ষাশাসনের যথার্থ বিকেন্দ্রায়ন হতে হবে একটি মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি। নতুন শিক্ষাক্রমের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা নিয়ে আরও বিচার–বিবেচনার সুযোগ ও প্রয়োজন আছে। কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ধর্মশিক্ষা একটি বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে সব স্তরে। বর্তমান ধর্মীয় আচার ও রীতিভিত্তিক প্রতি ধর্মাবলম্বীর ভিন্ন পাঠ্য ও পাঠদান সব ধর্মের আধ্যাত্মিক ও মানবিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্মানবোধ তৈরির পরিবর্তে ধর্মীয় বিভাজন ও ব্যবধান সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ধর্মশিক্ষার অন্তত অর্ধেক সময় সব শিক্ষার্থীর জন্য একসঙ্গে হতে পারে সবার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে মাতৃভাষায় দক্ষতা ও গাণিতিক দক্ষতার ভিত্তি তৈরি করা দরকার এবং এ জন্য উপযুক্ত সময়বিন্যাস করে এই ভিত্তিমূলক দক্ষতার জন্য যথেষ্ট পাঠদান সময় দিতে হবে। প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সময়ের অপচয় ও পণ্ডশ্রম। আশির দশকে এক স্বৈরশাসকের জনতুষ্টিমূলক সিদ্ধান্তে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণি থেকে ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় করানোর সূচনা হতে পারে, যেমনটি ছিল অতীতে। নতুন শিক্ষাক্রমে কো–কারিকুলার বা সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য সময় নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং এটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সহশিক্ষা কার্যক্রম হতে হবে শিশুর বিদ্যালয় অভিজ্ঞতার অবিচ্ছেদ্য ও আনন্দের উপাদান। মূল্যবোধ ও চরিত্র গঠনের এটি প্রধান উপজীব্য। সপ্তাহে দুই দিন প্রস্তাবিত ছুটির পরিবর্তে এক দিন বা দুই অর্ধদিন সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত হতে পারে।

শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের বিদ্যালয়ে যাপিত সময় অতি মূল্যবান সম্পদ এবং তা যথার্থ কাজে লাগাতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষার বর্ষপঞ্জি নিয়ে ভাবতে হবে। খ্রিষ্টীয় বর্ষের প্রথম মাসে শিক্ষাবর্ষ শুরু করার বিশেষ কোনো যুক্তি নেই। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল–মে বাংলাদেশের আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্যোগমুক্ত ও নাতিশীতোষ্ণ। বর্তমানে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ষশেষের পরীক্ষা ও বর্ষশুরুর আয়োজনে আসল পড়াশোনা বিশেষ হয় না। সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাবছর শুরু হলে মে–জুন পর্যন্ত অবিরাম শিক্ষার কাজ চালিয়ে জুনে বর্ষশেষ পরীক্ষা নেওয়া যায়। জুলাই–আগস্টে হতে পারে বার্ষিক ছুটি।

মহামারির কবলে বিপর্যস্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলে সময়ের প্রয়োজনীয় সমন্বয় করে ২০২১ সালে নতুন শিক্ষাবর্ষ পয়লা সেপ্টেম্বর তারিখে শুরু হতে পারে।


মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক