করোনাকালের অর্থনীতি-৩

নতুন রাজস্ব নীতিকাঠামো দরকার

>সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজস্ব নীতি বা ফিস্ক্যাল পলিসি এবং মুদ্রানীতি বা মনিটারি পলিসি। প্রথম পর্বে ছিল নতুন সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মৌল নীতি আর আজ শেষ পর্বে সংকট মোকাবিলায় নতুন রাজস্বনীতি।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বন জরুরি। ঘোষিত প্যাকেজে সামাজিক নিরাপত্তা, প্রকৃত খাত ও সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে রাজস্বনৈতিক কৌশলগুলো আলোচনা করা হয়নি। এখানে কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো।

ক্রমহ্রাসমান আয় ও কর্মসংস্থানের কারণে নতুন রাজস্বনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে কর্মসংস্থান। খাতভিত্তিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন, সর্বজনীন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মসংস্থান ধরে রাখা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোই বিশাল প্রণোদনার দাবিদার। এ মুহূর্তে বাজেট ঘাটতি ও ঋণ অনুপাতের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নয়। আমূল পরিবর্তন না করলে অর্থনীতি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থবির হয়ে যাবে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের আঘাত আসবে।

চলমান সংকট এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সঞ্চয়হীন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছে। দারিদ্র্যসীমা আন্তর্জাতিক সীমারেখার ওপর রাখতে হলে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকা অত্যাবশ্যক। এ ধরনের কর্মসূচির আওতায় পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয় সহায়তা ও স্বাস্থ্যভাতার অন্তর্ভুক্তি জরুরি। এ লেখকের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী এই সাত ধরনের ভাতার জন্য ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে, যা জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ। বহু দেশেই জিডিপির ১১ শতাংশের বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় হয়।

নগণ্য বাজেট, চিকিৎসা উপকরণের স্বল্পতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবা এবং অপরিকল্পিত খরচসহ বিবিধ কারণে স্বাস্থ্য খাত হুমকির সম্মুখীন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা আদর্শ সমাধান হতে পারে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন থাকাকালে সাময়িকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য ভাতার আওতায় আনা যেতে পারে। প্রত্যেকের জন্য পারিবারিক চিকিৎসক, নার্স ও অবকাঠামোর জন্য বাড়তি ব্যয় নির্বাহে জিডিপির ৬ শতাংশের মতো ব্যয় করতে হবে।

সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন না হওয়ায় মানসম্মত শিক্ষা সীমিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দক্ষতা সরবরাহে বিশাল ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। চলমান উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, দক্ষতার বিকাশ ও সক্রিয় নাগরিকত্ব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলনে সরকারের জিডিপির ৬ শতাংশের মতো ব্যয় লাগবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত খাতসমূহ কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই ঝুঁকির মুখে ছিল। সবুজ বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে কৃষি খাতের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের মুনাফা কমে গেছে। নতুন প্রযুক্তির কোনো প্রয়োগ ও প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে দেখা যায়নি। উৎপাদনশীলতা, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা, পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্যের অভাব শিল্প খাতকে প্রধানত পোশাকশিল্প-নির্ভর করেছে। এ খাতেও রপ্তানি কমেছে। দক্ষতার স্বল্পতায় নথিভুক্ত এবং অনথিভুক্ত বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রেমিট্যান্স হিসাবে বড় অংশ বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের আন্তপ্রবাহ কমায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।

লকডাউনের কারণে মাঠে পড়ে আছে ফসল, বড় ক্ষতির মুখে কৃষক। এ মুহূর্তে তাঁদের নেই কোনো আয়, নেই সঞ্চয়ও। অনাহার-অর্ধাহারে কাটছে দিন। কৃষকদের ফসল তোলার এ সময় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সরকারকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনতে হবে। সার, বীজ ও কীটনাশকে আর্থিক ভর্তুকি চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর মওকুফের ব্যবস্থা নেওয়াও বাঞ্ছনীয়। খাদ্য মজুতের পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এলাকাভিত্তিক খাদ্য কিনে খাদ্য সাহায্য কর্মসূচি চালু রাখা যেতে পারে। কৃষক খাদ্য উৎপাদন করে বাজারে সঠিক দামে বিক্রি করতে না পারলে পরবর্তী ফসল উৎপাদন করতে নিরুৎসাহিত হবে অথবা উৎপাদন করার অর্থবল হারাবে। খাদ্যসংকটও দেখা দেবে।

ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিক উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে ঘাটতি এলাকায় শ্রমিকদের প্রবেশের সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বিগত বছরগুলোতে ধান কাটা মৌসুমে কৃষিশ্রমিকের সংকট পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া কৃষিশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সঠিক নির্দেশনা থাকতে হবে। পাশাপাশি বোরোতে ক্ষতি হলে সেটা আউশে কীভাবে মেটানো যায়, সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। এ বছর আউশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। এর মধ্যে শ্রমিক আছেন প্রায় ৫ লাখ। এঁদের মধ্যে মার্চের প্রথম ২০ দিনেই এসেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা না পেলে তাঁরা টিকতে পারবেন না। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অনেক প্রতিষ্ঠান কম জনবল নিয়ে কাজ চালাতে চাইবে। প্রবাসীদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে। বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনা করে আগাম পরিকল্পনা শুরু করা দরকার।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা এবং ভর্তুকি প্রদান তথা অনুদান, কর অবকাশ, কর অব্যাহতি ফলাফল লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হতে হবে। আজতক সহায়তার মূল সুবিধাভোগী গোষ্ঠীতন্ত্র। প্রদানকৃত সহায়তা অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে ব্যবহৃত না হয়ে বিদেশে পাচার হচ্ছে।

পুনরুদ্ধার এবং পুনর্গঠনের জন্য তিনটি লক্ষ্য বা মিশনভিত্তিক—বৈচিত্র্যকরণ, সবুজ শিল্পায়ন ও দেশব্যাপী গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবনী সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন তথা ইক্যুইটি ম্যাচিং তহবিল গঠন করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও মধ্যম এবং নতুন উদ্যোক্তাদের প্রাধান্য প্রাপ্য। বড় উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, পণ্য বৈচিত্র্য, মূল্য সংযোজন, সবুজায়ন ও বিকল্প রপ্তানি সৃষ্টি প্রভৃতি শক্ত শর্ত আরোপ করা দরকার। প্রতিটি ধাপের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করে পরবর্তী সহায়তা প্রদান করতে হবে। এতে ঋণখেলাপি ও রুগ্‌ণ শিল্পকারখানা নিয়ে আগের অভিজ্ঞতা এড়ানো সম্ভব হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবনী তহবিল থেকে কারখানা ও উৎপাদনকেন্দ্রগুলো প্রধান মহাসড়ক ও নদীতীরবর্তী স্থানে স্থাপন করলে শিল্পায়নের জন্য জরুরি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সহজলভ্য হবে। দেশব্যাপী শিল্পায়নের কারণে আঞ্চলিক অসমতা কমবে।

ক্রমবর্ধমান পরিবেশ বিপর্যয় ও কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যে যোগসূত্র বিদ্যমান। অনতিবিলম্বে খনিজ উত্তোলন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্যান্য প্রকল্প থেকে পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ বাঞ্ছনীয়।

স্থানীয় সরকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা এবং তা যথেষ্ট শক্তিশালী করাটা জরুরি। জনগণের জন্য সত্যিকার গণতন্ত্র নিশ্চিত করার উপলব্ধিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকারকে যথাযথ মূলধন, দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে, যাতে স্থানীয় অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে ।

২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন অর্জন তথা জলবায়ু পরিবর্তনরোধ, সবুজ শিল্পায়ন এবং অসমতা রোধে বিশ্বের সব দেশকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। সমুন্নত উন্নয়ন চিন্তা আগামীর পথকে সুগম করবে এবং তা নিশ্চিত করতে মার্শাল প্ল্যান ও ম্যানহাটন প্রজেক্টের মতোন বিশাল বহুপাক্ষিক উদ্যোগের প্রয়োজন। পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুদান ও ঋণ মওকুফ জরুরি। দুর্যোগের মাত্রা এবং ব্যাপকতা বিবেচনায় এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত বৈদেশিক সাহায্য অপ্রতুল।

যেকোনো রাষ্ট্রে সমন্বিত উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকার ও বহুপাক্ষিকতার ওপর জনগণের আস্থা স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে বিবেচনায় অর্থনৈতিক অধোগতিকে থামিয়ে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় উদ্যোগ গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়!

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
rt@du.ac.bd