একবিংশ শতাব্দীতে একদিকে আমরা যেমন বিজ্ঞানের অতি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নয়নযজ্ঞে গা ভাসাচ্ছি, এর ফলে আমাদের জীবন হয়েছে সুখকর, আনন্দময় ও গতিশীল; তেমনি এই অতি আধুনিক প্রযুক্তির কিছু অপব্যবহার সমাজে তৈরি করেছে এক অমোঘ নেতিবাচক বাস্তবতার, যা মানুষের মনে জন্ম দিয়েছে অচেনা প্রতিক্রিয়ার। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে ঘরে ঘরে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ফলে পরিবারের একসঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে মিলেমিশে থাকার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তদুপরি সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি হওয়ায় সৃষ্টি করছে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য, নিজের অবস্থান দৃঢ় করার নিমিত্তে তারুণ্যসহ যুব সম্প্রদায়ের আজ শুধুই ছুটে চলা, সামাজিক অবক্ষয়ের গ্রাসে মানবিক মূল্যবোধ অবনমিত, রুচিশীল সুস্থ স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের অভাব, লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের অভাব—এসব মিলিয়েই আজ আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ: একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর হতাশা। ঠিক এই সুযোগেই সমাজের পঙ্কিল দুষ্টচক্র সক্রিয় হয়ে যুবসমাজের হাতে তুলে দিচ্ছে ড্রাগ।
এই মাদকের নেশা শুধু ব্যক্তির সম্ভাবনাময় জীবনকেই গ্রাস করছে না; সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবার, সমাজ, তথা সমগ্র জাতিকে গ্রাস করে দিচ্ছে, যা এক গভীর চক্রান্ত। আন্তর্জাতিক মাফিয়ার লোলুপ দৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আমরা সবাই জানি, দেশ ও জাতির আশা-ভরসাস্থল হলো আমাদের যুব সম্প্রদায়, আমাদের তরুণ প্রজন্ম। পৃথিবীতে যত মহৎ কাজ হয়েছে, প্রতিটির পেছনে রয়েছে এই তরুণ ও যুব সেনানীদের অসামান্য অবদান।
আজকের এই তরুণ ও যুবকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মাদকের ভয়াল আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ ও যুবকেরা নতুন নতুন মাদকে বেশি ঝুঁকছে। একসময়ে আমাদের কিছু বখাটে লোকজন সমাজে ভাং, আফিম, গাঁজা ইত্যাদি ব্যবহার করত, কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ও বর্তমানে মাদকের প্রকৃতি, গুণগত ও পরিমাণগত দিক থেকে দিন দিন আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক মাদক থেকে কৃত্রিম মাদক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে মাদক হিসেবে ফেনসিডিল, হেরোইন, মারিজুয়ানার সঙ্গে নতুন আরও মাদক হিসেবে যোগ হয়েছে এলএসডি, ব্রাউনি বা গাঁজার কেক, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, এমডিএমএ, খাট, ব্যথানাশক ট্যাবলেট ট্যাপেন্টাডল, স্ক্যাফ সিরাজ ও এমফাটিমিন পাউডার, ককটেল বা ঝক্কি। দেখা যাচ্ছে, অধুনা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানেরা পড়ালেখা করার জন্য দেশের বাইরে অবস্থানকালেই জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব মাদকে।
দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়ে নতুন মাদক ডিএমডি গ্রহণ ও আসক্ত হচ্ছে অনেকে। আবার ইউরোপ বা অন্য কোথাও গিয়ে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরলেও অনেকের আসক্তি থেকে যায়। ফলে এই মরণনেশা থেকে বের হতে পারছে না। আমাদের কিছু অভিভাবক আছেন, যাদের কেউ কেউ ধারণা করেন যে বিদেশে পাঠালেই তাঁর সন্তানের মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু দেশে আগে থেকে মাদকাসক্তদের অনেকে বিদেশে গিয়ে বরং নতুন নতুন দামি মাদকে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
গত ২৬ জুন শনিবার রাজধানী ঢাকায় ডিএমডি নামক মাদক ধরা পড়ে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশ প্রত্যাগত এই ধনীর দুলালেরা ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের কাছে এ ধরনের ব্যয়বহুল মাদক বিক্রি করে, আবার যাদের কাছে বিক্রি করে, তারও প্রায় প্রত্যেকেই ছাত্র। যাদের কোনো আয় নেই, এই উচ্চ ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবার, সমাজে তৈরি করছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানিসহ হত্যা-খুনের মতো সামাজিক অস্থিরতা।
নতুন মাদক ডিএমটি হলো হ্যালুসিনোজেনস গ্রুপের একটি মাদক। যা মস্তিষ্কের ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করতে এবং হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি তথা দেখা, শ্রবণ, গন্ধ, স্বাদ বা অস্তিত্ব নেই, এমন জিনিসগুলোকে অলীকভাবে স্পর্শ করে। এভাবে তারা কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। রাসায়নিক দিক থেকে ডিএমটি হলো এন এন ডাইমিথাইলট্রিপটামিন, যা বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়।
মাদকের নেশা শুধু ব্যক্তির সম্ভাবনাময় জীবনকেই গ্রাস করছে না; সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবার, সমাজ, তথা সমগ্র জাতিকে গ্রাস করে দিচ্ছে, যা এক গভীর চক্রান্ত। আন্তর্জাতিক মাফিয়ার লোলুপ দৃষ্টির সঙ্গে জড়িত।
ডিএমটি-যুক্ত উদ্ভিদ ও লতাগুলো সেদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী আমাজনীয়রা সাধারণত আয়ুয়াস্কা পানীয়তে (আয়ুয়াস্কা ব্রেউ) ডিএমটি ব্যবহার করে। এর ফলে কিছু দেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে গভীর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে ডিএমটি তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ডিএমটি ব্যবহারকারীরা সমুদ্রসৈকতে পাহাড়ি রিসোর্ট বা কোনো বিনোদনকেন্দ্রে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই মাদকের ব্যবহার করে থাকে বলেও জানা গেছে। তদুপরি অধুনা ডিএমটি পরীক্ষাগারেও প্রস্তুত করা যায়।
এটা সাধারণত তিনভাবে গ্রহণ করা হয়—ধূমপানের মাধ্যমে, ইনজেকশনের মাধ্যমে, আয়ুয়াস্কার মতো করে (চা খাওয়ার মতো) খাওয়া হয়। ডিএমটি নিয়মিত ব্যবহার করলে সম্ভাব্য যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে তা হচ্ছে, হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি, বুকে ব্যথা, চোখের মণি বড় হওয়া, চোখের দ্রুত ছন্দগত গতি বৃদ্ধি পাওয়া,মানসিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ড্রাগ খাওয়ার পর অনেক দিন ধরে স্থায়ী হয়। তা ছাড়া ডএমটি ভয়াবহ হ্যালুসিনেশন তৈরির মাধ্যমে গভীরভাবে কল্পনার জগতে প্রবেশ করায়, যা মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে। একপর্যায়ে তা এমনকি জীবননাশের কারণ হতে পারে।
যারা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেসব প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ ধরনের অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হতে পারে। তদুপরি আমাদের এই তরুণ ও যুব সম্প্রদায়কে নিশ্চিত মৃত্যুঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
আমরা ক্রমেই এমন এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা—এসব শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর জায়গা দখল করে নিয়েছে অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ-জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দ। পারিবারিক বন্ধন, নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা জরুরি। নীতি নির্ধারক, বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রকৃত অর্থেই যুদ্ধ ঘোষণা করে সমাজ থেকে মাদককে চিরতরে দূর কারার পথ ধরতে হবে।
দিলীপ কুমার সাহা বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক।