জাপানে যুগ বা কালের নামকরণ হয়ে থাকে সম্রাটের শাসনকালকে ঘিরে। এই ব্যবস্থা প্রাচীনকাল থেকে চলে এলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রচলন খুব বেশি দিন আগে নয়। ১৮৬৮ সালে মেইজি পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে সম্রাটের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে যুগের নামকরণের এ ব্যবস্থা সরকারিভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে।
সম্রাট মুৎসুহিতোর সেই কাল চিহ্নিত হয়েছিল মেইজি যুগ হিসেবে এবং মৃত্যুর পর সম্রাটকে তাঁর কালের সেই নামেই চিহ্নিত করা হয়। সম্রাটের রাজত্বের সময়ে নতুন এক নামে চিহ্নিত করার এই রীতি নিয়ে সেই সময় থেকেই জাপানিদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পেছনে মূলত আছে নতুন এক যুগে মানুষের প্রত্যাশার বিষয়টি। ফলে নাম বেছে নেওয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সমাজের নানা ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জাপানের প্রত্যাশার দিকটি ফুটে ওঠে। এপ্রিল মাসের শেষ দিনে সম্রাট আকিহিতোর ৩০ বছর ধরে সম্রাটের দায়িত্ব পালনের সমাপ্তি হতে যাওয়া যুগের হেইসেই নামকরণ করা হয়েছিল স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশার কথা চিন্তা করে।
১৯১২ সালে মেইজি সম্রাটের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মেইজি যুগের সমাপ্তিতে যে তাইশো যুগের সূচনা, সেটা ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষণস্থায়ী; ১৯১২ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত। তাইশো সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে হিরোহিতো রাজত্ব করেছিলেন ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এবং তাঁর রাজত্বের সেই কাল পরিচিত শোওয়া যুগ হিসেবে। শোওয়া সম্রাটের রাজত্বকালে জাপানে ঘটেছে তাৎপর্যপূর্ণ নানা পরিবর্তন, যেসব পরিবর্তনের সূত্র ধরে সম্রাটও নেমে এসেছেন তাঁর ঐশ্বরিক আসন থেকে জনতার কাতারে এবং হারিয়েছেন সর্বময় ক্ষমতা। জাপানের সম্রাট এখন ইউরোপে রাজতন্ত্র চালু থাকা দেশগুলোর মতোই কেবল রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন, যে ক্ষমতা এখন ন্যস্ত নাগরিকদের হাতে।
দেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ সম্রাট দিয়ে থাকলেও সংসদের বেছে নেওয়া প্রার্থীর বাইরে অন্য কাউকে সেই পদে তিনি নিয়োগ দিতে পারেন না। একই সঙ্গে সংসদের নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের সুপারিশে সংসদ তিনি ভেঙে দিতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্রাটকে নিতে হয় সংসদের সুপারিশের ভিত্তিতে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার আলোকে নয়। ফলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেও নানা রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে সেই দায়িত্ব সম্রাটকে পালন করতে হয়। তারপরও নৈতিক অবস্থানগত দিক থেকে সম্রাটের রয়েছে বড় প্রভাব, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে সেই প্রভাব কাজে লাগাতে সম্রাটকে দেখা যায়নি।
শোওয়া সম্রাট হিরোহিতো ১৯৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করলে ছেলে আকিহিতো সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁর কালের নামকরণ করা হয় হেইসেই যুগ। জাপানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথম সম্রাট হিসেবে মৃত্যুর আগে সিংহাসন ত্যাগের প্রস্তুতি তিনি এখন নিচ্ছেন এবং ৩০ এপ্রিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছেড়ে দিলে যুবরাজ নারুহিতো সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন। সেই প্রস্তুতি এখন পুরোদমে চলছে এবং জাপান অপেক্ষায় আছে নতুন একটি কালের সূচনা হতে যাওয়ার।
সম্রাট আকিহিতোর সিংহাসন ত্যাগ ও নতুন সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের এক মাস আগে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন যুগের নামকরণের ঘোষণা জাপান সরকার দেবে। সেই হিসাব অনুযায়ী এপ্রিল মাসের ১ তারিখে সরকার ঘোষণা প্রচার করবে এবং ৩০ এপ্রিল সম্রাট আকিহিতো ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার এক দিন পর, ১ মে যুবরাজ নারুহিতো নতুন সম্রাটের দায়িত্ব নেবেন। আধুনিক জাপানের ইতিহাসে এবারই প্রথম সম্রাটের জীবদ্দশায় সিংহাসন ত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা হতে যাওয়ায় জাপান এখন এক নতুন সন্ধিক্ষণে উপস্থিত।
নতুন যুগের নামকরণের বিষয়টি সরকারের ভেতরের মহলে ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়ে গেলেও ১ এপ্রিল মধ্য-দিনে জাপানের মন্ত্রিসভার চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিহিদে সুগা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে নতুন নামকরণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন এবং পরবর্তী এক মাসে নতুন সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পর্কিত নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা যুবরাজ নারুহিতোকে সেরে নিতে হবে। এরপর ১ মে থেকে জাপানের সম্রাটের দায়িত্ব পালন তিনি শুরু করবেন। নতুন সম্রাটের অভিষেক অবশ্য অনুষ্ঠিত হবে অক্টোবর মাসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হবে।
জাপানের সংবাদমাধ্যমে এই রদবদলের খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকায় নাগরিকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ রকম নাগরিক উৎসাহের একটি দিক কিছুদিন আগে পর্যন্ত অবশ্য ছিল পরবর্তী যুবরাজকে ঘিরে। সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে জাপানের সংবিধানে সরাসরি কিছু উল্লেখ করা হয়নি এবং ইম্পিরিয়াল হাউসহোল্ড ল বা রাজপরিবার–সংক্রান্ত আইন হচ্ছে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি করে নেওয়ার ভিত্তি। সেই আইনে উল্লেখ আছে, একমাত্র পুরুষ উত্তরসূরিরাই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হতে পারবেন। ফলে আইন অনুযায়ী নারী সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত।
যুবরাজ নারুহিতো একমাত্র কন্যাসন্তানের বাবা হওয়ায় পরবর্তী যুবরাজ হতে পারার যোগ্যতা এখন বর্তাবে বর্তমান যুবরাজের ছোট ভাই রাজপুত্র ফুমিহিতোর ওপর এবং সেই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে তাঁর ১০ বছর বয়সী রাজপুত্র হিসাহিতো। নারী-পুরুষের সম–অধিকারে বিশ্বাসী জাপানের অনেকেই এটাকে দেখছেন জাপানে নারীর সম–অধিকার অর্জিত হওয়ার পথে বড় এক বাধা হিসেবে। সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে নারী-পুরুষের সম–অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্য জাপানে অনেক দিন থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। সরকারি পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও কোনো রকম সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত গৃহীত না হওয়ায় যুবরাজ নারুহিতোর মেয়ে উত্তরাধিকার আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।
জাপানের রাজতন্ত্রকে ঘিরে এ রকম কিছু অমীমাংসিত বিষয় থেকে গেলেও নতুন সম্রাটের কাছ থেকে প্রত্যাশাও একেবারে কম নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে বর্তমান সম্রাটের সরাসরি ছত্রচ্ছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। সম্রাট আকিহিতোকে জাপানের ক্ষমতার কেন্দ্রে বিরাজমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি উদার মনোভাবাপন্ন ও শান্তিবাদী হিসেবে দেখা হয়। আর তাঁর ছেলে নারুহিতোর জন্ম যুদ্ধোত্তর জাপানে হওয়ায় যুদ্ধকালীন জাপানের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তায় তিনি প্রভাবিত হবেন না বলেই জাপানে অনেকের প্রত্যাশা।
মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক