মালয়েশিয়া আমাদের খুব কাছের একটি বন্ধুদেশ। উড়োজাহাজে যেতে লাগে চার ঘণ্টারও কম। দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিস্তৃত হয়ে চলেছে। দেশটির রাজনৈতিক স্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কিছুটা চিন্তা থাকলেও অর্থনীতিতে তার লাগাতার ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সেই চিন্তা ম্লান করছে। বরং একটি চিত্র ছবির মতো পরিষ্কার যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়েশিয়া ইতিবাচক অর্থে বাংলাদেশিদের জন্য একটি নির্ভাবনাময় সেকেন্ড হোম হয়ে উঠতে পারে।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিরা অনবরত ঢুকছেন। অস্থিরতাও কম নেই। মালয়েশিয়া সরকার একাদিক্রমে তিন দফায় শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও শয়ে শয়ে অবৈধ বাংলাদেশি এখনো বৈধ হওয়ার দরখাস্ত দিতে দ্বিধান্বিত। তাঁরা অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি বৈধভাবে আছেন। বৈধ হওয়ার সুযোগের আওতায় গত প্রায় দুই বছরে পাঁচ লাখের বেশি বাংলাদেশি বৈধ হতে দরখাস্ত করেছেন। কিন্তু তারপরও আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব অবৈধ বাংলাদেশি দরখাস্ত করবেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, কিছু বাস্তব জটিলতা এবং চাকরি-এজেন্টদের দ্বারা বৈধকরণ-বিরোধী অপপ্রচার এখনো জোরালো। ওই এজেন্ট বা দালালচক্র বলছে, বৈধ হতে গেলে শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাঁরা পারমিটও পাবেন না। বরং তাঁদের জোর করে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু কর্মকর্তারা এই আশঙ্কা অমূলক বলে নাকচ করে দিয়েছেন। একজন স্থানীয় সংবাদদাতা আমাকে বলেছেন, অপপ্রচারকারীরা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এরাই এর আগে বৈধ হতে তাদের দরখাস্ত দেওয়া ঠেকিয়ে রেখেছে।
তবে কিছু টানাপোড়েন এবং দালালদের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও মালয়েশীয় শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক এখানে এসে মূলত সেবা খাতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের মাথাপিছু খরচ হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। তবে প্রকৃত খরচ ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা হওয়ার কথা।
২৪ সেপ্টেম্বর। মালয়েশীয় বিমানবন্দরের অদূরে প্রায় ১০ জন বাংলাদেশি তরুণের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁরা সমস্বরে আমাকে জানালেন, প্রায় এক মাস আগে গড়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে তাঁরা প্রত্যেকে মালয়েশিয়ায় এসেছেন। মাসে বেতন পাবেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। তাঁরা জানিয়েছেন, কিছু দরকারি খরচ বাদ দিলে সেখান থেকে তাঁদের ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা টিকবে। কোম্পানির চাকরি করলেও এজেন্টদের কাছে তাঁরা জিম্মি। সবার পাসপোর্ট এজেন্টের কাছে। সুতরাং, তাঁদের চাকরির মেয়াদ নবায়নের বিষয়টিও এজেন্টের কাছে থাকবে। দেখলাম, তাঁরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, কেন অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকেরা বৈধ হতে চান না। এর কারণ হলো, তাঁদের ভাষায় বৈধ হওয়ার জন্য মাথাপিছু প্রায় ১ হাজার ৮০০ রিঙ্গিত খরচ হলেও ওই এজেন্টদের তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রিঙ্গিত (১ রিঙ্গিত এখন প্রায় ২০ টাকা সমমানের) দিতে হবে। এবং প্রতিবছরই ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ এবং সেই সঙ্গে হয়রানির শিকার হতে হবে। তাঁদের মধ্যে একজনের ছোট ভাই বহু বছর মালয়েশিয়ায় আছেন। তাঁর কথায়, কিছু আয় কম হলেও তাঁর ওই ভাই সর্বদা কাগজপত্র বৈধ রাখেন।
২০১৬ সালে সরকার বিদেশি শ্রমিকদের বৈধ হতে ছয় মাসের একটি সময় ঘোষণা করেছিল। এতে তেমন সাড়া দেননি বাংলাদেশিরা। এরপর মালয়েশিয়া আরও ছয় মাস, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ায়। এতেও তাঁদের হুঁশ ফেরেনি। এ রকম প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের মধ্য জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজাকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপরই মালয়েশীয় সরকার তাদের ‘রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম’ আরও এক বছর বৃদ্ধি করে। এবং প্রথমবারের মতো যাঁরা বেআইনিভাবে এসে বেআইনি রয়ে গেছেন, তাঁদের বৈধতা দিতে ই-কার্ড চালু করে। তাঁরা সংখ্যায় অল্প। যাঁরা বৈধভাবে এসে অবৈধ হয়েছেন, তাঁদের জন্য ওই রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুধু এক দিনে বাংলাদেশ মিশন নতুন পাসপোর্ট দিতে তালিকাভুক্ত করে ১ হাজার ৩৯৮ জনকে। ওই দিন ১ হাজার ৩৮৮টি পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়। ওই দিনই তারা ১৭৩টি ট্রাভেল পারমিট বিলি করে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে (বিয়ে, বিয়ের সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স) ৯৭টি সনদ ওই দিনই বিতরণ করা হয়। এখন চ্যালেঞ্জ হলো, এই নিয়মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। তবে সে জন্য কর্মরত শ্রমিকদের সচেতন করাও জরুরি।
এ বছরের গোড়ায় বাংলাদেশ মিশন সরিয়ে নেওয়া হয়। মিশনের নতুন ভবনটি অবশ্য আধুনিক এবং দ্রুত সার্ভিস প্রদানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। গত অন্তত দেড় বছর দূতাবাসের ওপর দিয়ে ঝড় বইছে। প্রতিদিন গড়ে তারা প্রায় ৮০০ পাসপোর্ট দেয়। গড়ে আড়াই হাজারের বেশি লোক কনস্যুলার-সুবিধা নেন। কাজ সামলাতে ঢাকা থেকেও বিশেষ টিম আনতে হয়েছিল।
শেখ হাসিনা-রাজাক টেলিফোন আলাপের পরে বৈধ হওয়ার যে বর্ধিত সুবিধা, তা বহুলাংশে বাংলাদেশিরাই গ্রহণ করছেন। কারণ, গত আট মাসে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় বহুগুণ বেশি বাংলাদেশি দরখাস্ত করেছেন। কনস্যুলার-সুবিধা দিতে পেনাং, জহোর বারু, কেদাহ, সারোয়াকসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের যেতে দেখা যাচ্ছে। বৈধতা-সংক্রান্ত দ্বিধা কাটাতে তাঁরা প্রায় দেড় হাজার মালিকের সঙ্গেও কথা বলেন। ইতিমধ্যে সোয়া পাঁচ লাখ বাংলাদেশি দরখাস্ত জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইতিমধ্যে বৈধতার পারমিট পেয়েও গেছেন। সত্যি এটা একটা এলাহি কাণ্ড।
এ ছাড়া এনফোর্সমেন্ট কার্ড বা ই-কার্ডের আওতায় ১ লাখ ২ হাজারের ওপর বাংলাদেশি এবার সুবিধা নিতে পেরেছেন। তাঁদের সংখ্যা অবশ্য উল্লিখিত সোয়া পাঁচ লাখের মধ্যে রয়েছে। ই-কার্ড তাঁরাই পেয়েছেন, যাঁরা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে যেমন নৌকাযোগে বা স্থলসীমান্ত পথে ঢুকেছেন। ই-কার্ডের শর্ত হলো দরখাস্তকারীকে কমপক্ষে ছয় মাস মালয়েশীয় কোনো কোম্পানিতে কাজ করার প্রমাণ দিতে হবে।
মালয়েশিয়ার অনেক বড় বড় ভবন নির্মাণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ঘাম লেগে আছে। বহু উচ্চ ভবন ও স্থাপনার কারিগর তাঁরা। মালয়েশীয় উপপ্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি সংসদে বাংলাদেশি জনশক্তির দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে ২০ লাখ শ্রমিক নেওয়া–সংক্রান্ত একটি তথ্য দিলে তা মালয়েশীয় মিডিয়ায় বিতর্ক তৈরি করে। এরপর তিনি স্পষ্ট করেন, ২০ লাখ বাংলাদেশিকে নিয়োগের কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিদেশে কাজে আগ্রহী এ রকম ২০ লাখ শ্রমিকের একটি তথ্যভান্ডার রয়েছে। সেখান থেকে মালয়েশীয় কোম্পানিগুলো চাহিদা অনুযায়ী সময়ে সময়ে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ করতে পারে।
মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ লাখ বলে ধারণা করা হয়। তবে এটা সত্যিই ২০ লাখ ছাড়াতে খুব বেশি সময় না–ও লাগতে পারে। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৬টি কোম্পানি ৮৮ হাজার ৫৮৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিক চেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন ৬৭ হাজার ২১১ জনকে আসতে ছাড়পত্র দিয়েছে। ১০ মার্চের পর থেকে ৩৩ হাজার চলেও এসেছেন দেশটিতে। এভাবে মালয়েশীয় শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার বিস্তৃত হচ্ছে।
শ্রমিক আমদানির উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গত অক্টোবরে অন্তর্ভুক্ত করা একটি মাইলফলক অগ্রগতি। বাংলাদেশ হলো ১৫তম এবং সর্বশেষ উৎস দেশ। অন্যরা হলো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান।
এদিকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় ২১ কোটি ১০ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে। এর ৭৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। পাঁচ বছর আগে এই রপ্তানি ছিল মাত্র প্রায় ৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তৈরি পোশাক ছাড়া আছে শাকসবজি, হিমায়িত খাদ্য, সিরামিকস। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করেছে ১২০ কোটি ডলার। এর ৪৫ শতাংশই হলো জ্বালানি তেল ও পাম তেল।
সেকেন্ড হোম নিয়ে একটা উদ্বেগ আমাদের সমাজে আছে। সেকেন্ড হোমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওপরের দিকে রয়েছে।
এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম পেয়েছেন বলে একটি সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রশ্নের জবাবে মালয়েশীয় পর্যটনমন্ত্রী নাজরি বিন আবদুল আজিজ সম্প্রতি ওই তথ্য দেন বলে একটি সূত্রের দাবি। গত মার্চে পর্যটনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চীন (৭৯৭৬) ও জাপানের (৪১২৭) পরই বাংলাদেশ (৩৩৯৯)।
ওয়াকিবহাল সূত্র আমাকে ধারণা দেন, সেকেন্ড হোমের সুযোগ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত। বাংলাদেশে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা তাঁদের সম্পদ রয়েছে। তাঁরা সবাই বাংলাদেশি সহায়-সম্পদ ত্যাগ করে এসেছেন, তা নয়। তাঁরা সাধারণত আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। বেশির ভাগ কুয়ালালামপুরের আশপাশে থাকেন। বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম উদ্বেগ হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, যেটা জমা দিতে হয়, হুন্ডির মাধ্যমে আনা হলো কি না। কিন্তু এটা চিহ্নিত করা কঠিন। যেমন কারও পক্ষে কোনো মালয়েশীয় নাগরিক টাকাটা দান হিসেবে শোধ করেন। এরপর তিনি তা হুন্ডিতে পেয়ে যান। আইন ধরতে পারে না।
আরও একটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অপরাধমূলক কাজে বাংলাদেশিদের জড়িয়ে পড়া। আওয়ামী লীগের মালয়েশীয় শাখার একজন পদস্থ নেতা ও ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, পতিতাবৃত্তিতে বাংলাভাষী মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও দেশটির মোট বাংলাদেশি অভিবাসীর মধ্যে মেয়েরা ১ শতাংশেরও কম। অনেকের ধারণা, ভারত থেকে তাড়া খাওয়া সন্দেহভাজন বাংলাদেশি জঙ্গি বা অন্য অপরাধীরা ইদানীং মালয়েশিয়াকে বেছে নিয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মালয়েশীয় বিমানবন্দরে জায়েদ নামের এক বাংলাদেশিকে উড্ডয়নের আগমুহূর্তে বিমান থেকে নামিয়ে অন্তরীণ করা হয়। তবে তিনি সন্দেহভাজন জঙ্গি, নাকি অভিবাসন আইন লঙ্ঘন করেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বাংলাদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যে মালয়েশীয় মেয়েদের বিয়ে করা সূত্রে সে দেশের মূলধারায় মেশার সুযোগ তৈরি করছেন। মালয়েশীয় আইনে দেশে বিদেশি বিয়ে নিষিদ্ধ। তাই বিয়েটা বাইরে চলে। মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক আলোচনায় রসিকতা করে বলেন, এখানকার বাংলাদেশি তরুণেরা তো শাহরুখ খান! শাহরুখ খানরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটাবেন, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷