কলকাতার চিঠি

নকশালবাড়ি মুছে যায়নি

ইতিহাসের পাতা থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলন মুছে যায়নি। এই তো ২৪ মে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর পার হলো। ১৯৬৭ সালের ২৪ মে যে আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল এই পশ্চিমবঙ্গ, সেই নকশালবাড়ি এখনো ইতিহাসের পথ বেয়ে জেগে আছে। তবে হারিয়েছে জৌলুশ। আন্দোলনের ঐতিহ্য। স্তিমিত হয়ে গেছে সেই আন্দোলন। তবু সেদিনের সেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের পতাকা হাতে নিয়ে এখনো কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছেন নকশালবাড়ির সেই ঐতিহাসিক ভিটায়। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূতিকাগারে। ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে। এই আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, নকশাল বাড়ি থাকবে। নকশালবাড়ির মৃত্যু নেই।

নকশালবাড়ি একটি আন্দোলনের নাম। বঞ্চনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার নাম। মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি ঝড়ের নাম। সেই আন্দোলন আজ ঝিমিয়ে পড়েছে, তবে সেই নকশালবাড়ি আজও আছে। নেই আজ নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ চারু মজুমদার, কানু সান্যালরা। সেই জঙ্গল সাঁওতালরা। আছে নকশালবাড়ির বিস্তীর্ণ ভিটে। ছোট্ট ছোট্ট আদিবাসী মানুষের বাড়ির ভিটে, যে ভিটায় রোপিত হয়েছিল নকশালবাড়ি আন্দোলনের বীজ। সেই ভিটে এখনো জাগ্রত।

এখনো এই নকশালবাড়িতে অতীতের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন মানুষ। স্মৃতিচারণা করেন সেদিনের সেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের। এই আন্দোলনই আজ ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের অন্তত ১০টি রাজ্যে, যেখানে এই নকশালবাড়ি আন্দোলনের পথ ধরে চলছে মাওবাদীদের আন্দোলন। সেই ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওডিশা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে। সেখানেই এখন নকশালবাড়ির আদর্শে চলমান মাওবাদী আন্দোলন তীব্র আকার নিয়েছে।

নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর স্মৃতিকে সামনে রেখে এবার নতুন করে জেগে উঠেছে নকশালবাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি একটি থানা। নেপাল সীমান্ত লাগোয়া এই থানার নকশালবাড়ি অঞ্চলের একটি এলাকা নিয়ে সেদিন গড়ে উঠেছিল এই নকশালবাড়ি আন্দোলন। আর সেই স্মৃতিকে সামনে এনে এবার এখানে উদ্‌যাপিত হলো নকশালবাড়ি আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব।

২৫ মে শিলিগুড়িতে বের হয়েছিল এক বিশাল লাল পতাকার মিছিল। সেই মিছিলে হেঁটেছেন হাজারো মানুষ। শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্ক, ইনডোর স্টেডিয়াম আর নকশালবাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল বিশাল জমায়েতের। সেই জমায়েত থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করে নতুন পথ দেখালেন সেই সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের নেতারা।

এই সংগঠনের ডাকে এদিন বাঘা যতীন পার্কের জমায়েতে দাঁড়িয়ে সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্য বলেন, ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন মরেনি, মরবে না। কৃষক যেখানে জমির জন্য আন্দোলন করবে, সেখানেই আসবে নকশালবাড়ি। নকশালবাড়িকে গত ৫০ বছরে বারবার মৃত ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু ৫০ বছর পরও জল-জঙ্গল-জমি বাঁচানোর জন্য দেশের যেখানে যেখানে মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে আছে, আজ সেখানে সেখানে নকশালবাড়ি পৌঁছে গেছে। যেখানে গো–হত্যার নামে গুন্ডামি হয় এবং তার বিরুদ্ধে গুজরাট সরব হয়ে ওঠে, দলিত জাগরণ হয়, আমরা সেখানে নকশালবাড়ির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।’ এই জমায়েতে অবশ্য সংগঠনের পলিটব্যুরোর সদস্য কার্তিক পাল, কবিতা কৃষ্ণন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক সাইফুর আলমও যোগ দেন। জমায়েতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ চারু মজুমদারের পুত্র ও দার্জিলিং জেলার সম্পাদক অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদার বলেছেন, ‘নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর থেকে ভাঙড়—বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার পথ দেখিয়ে কৃষকদের শক্তি জুগিয়ে চলেছে নকশালবাড়িই।’

ষাটের দশকে এই নকশালবাড়িতে সূত্রপাত হয় ভারতের সশস্ত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের। নেতৃত্ব দেন চারু মজুমদার। তখন নকশালবাড়ি এলাকার আদি বাসিন্দা ছিলেন মূলত রাজবংশীরা। ব্রিটিশ আমলে এই নকশালবাড়ি এলাকায় চা-বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে। এলাকার জোতদারেরা চা-বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে আসেন সাঁওতালিদের। বিহার, ওডিশা ও মধ্যপ্রদেশের পাশাপাশি পাশের দেশ নেপাল থেকেও আনা হয় শ্রমিক। চা-বাগানের মালিকেরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে থাকেন।

এরপরই বঞ্চিত শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য ছুটে আসেন চারু মজুমদার। সংগঠিত করেন সশস্ত্র বিপ্লব। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তিনি ১৯৬৭ সালে শুরু করেন সংগ্রাম এই নকশালবাড়িতে। ওই বছরের ২৪ মে আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে জমি দখলের সংগ্রামের সূচনা করেন। এরপরই চারু মজুমদারের বিপ্লবের এই তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী দীক্ষিত হন এই মন্ত্রে।

পশ্চিমবঙ্গের পথে পথে আওয়াজ ওঠে, ‘লাঙল যার জমি তার, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, নকশালবাড়ির পথ বিপ্লবের পথ, একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানল সৃষ্টি করে’ ইত্যাদি। তখন পশ্চিমবঙ্গজুড়ে চারু মজুমদারের বিপ্লবের তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরই ১৯৭২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতার একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চারু মজুমদারকে। ১৯৭২ সালের ২৮ আগস্ট কলকাতার পিজি হাসপাতালে মারা যান তিনি।

সরকারের এই তথ্যকে মেনে নেননি চারু মজুমদারের ভক্তরা। তাঁর একমাত্র পুত্র অভিজিৎ মজুমদার সরকারের তথ্যকে মিথ্যা বলে দাবি করে বলেছেন, ‘বাবা হাসপাতালে মারা যাননি। তাঁকে কলকাতার লালবাজারে পুলিশ লকআপে পিটিয়ে মারা হয়েছে। পরে সরকার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুর গল্প ফেঁদেছে।’ নকশালবাড়ির আরেক বিপ্লবী নেতা কানু সান্যালও বেঁচে নেই। তিনি ২০১০ সালের ২৩ মার্চ রোগে ভুগে মানসিক অবসাদে নকশালবাড়ির নিজের বসতঘরে আত্মহত্যা করেন। তাঁর বাড়ি ছিল নকশালবাড়ির শিবদালা গ্রামে।

আজ অবশ্য নকশালবাড়ির সেই কমিউনিস্ট আন্দোলন বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে এই মন্ত্রের আদর্শে বহু দল, উপদল। তবু স্মৃতি থেকে মুছে যাননি চারু মজুমদার। যাঁরা ১৯৬৭ সালে সশস্ত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিলেন। মুছে যাননি কানু সান্যাল বা জঙ্গল সাঁওতালরা। আজও তাঁরা জেগে আছেন ইতিহাসের পাতায়, ইতিহাস হয়ে। তাই তো এবার নকশালবাড়ির ৫০ বছর পূর্তির দিনে হাজির হয়েছিলেন বিপ্লবী কমিউনিস্টরা। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন গরিবদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে। গরিবদের নিয়ে ছেলেখেলা আর নয়? ফের ডাকও দিয়েছিলেন, এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে আবার নকশালবাড়ির আদর্শে বলীয়ান হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার। কিন্তু তা কি হবে? কারণ, নকশালবাড়ির এই আন্দোলন নিয়ে ইতিহাসে এখনো বিতর্ক আছে। ছিল। বিতর্ক আছে এই আন্দোলনের পথ নিয়ে।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি