আমনের ভরা মৌসুম চলছে। কৃষকদের ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠেছে। এমন সময়ে ধান–চালের দাম কম থাকে। ফলন বেশি হলে ধানের দাম বেশ কমে যায়, কৃষকের লোকসান হয়, আমরা তাঁদের লোকসান কমানোর জন্য সরকারকে অনুরোধ করি বাজারদরের চেয়ে বেশি দরে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে। সরকার কী করে, সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। আগে একটু চালের কথা বলে নিই।
ধানের দাম কমে গেলে স্বাভাবিকভাবে চালের দামও কমার কথা; কারণ, ধান থেকেই চাল হয়। কিন্তু বাংলাদেশি বিস্ময় হলো, ধানের কমলে চালের দাম কমে না। আরও ঠিকভাবে বললে, ধানের দাম যতটা কমে, চালের দাম ততটা কমে না।
এই বিস্ময়ের সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। চালের দাম গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেলে সরকার ভাবল, বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হলে তার প্রভাবে দেশের বাজারে চালের দাম কমতে পারে। তাই বেসরকারি খাতের চাল আমদানিকারকদের উৎসাহিত করার জন্য চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিল। গত মাসের শেষ সপ্তাহে এই সিদ্ধান্তের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটল, সেটাই বিস্ময়। এক দিনের মধ্যেই দেশের বাজারে ধানের দাম কমে গেল মণপ্রতি ১০০ টাকা।
ধানচাষিদের দুর্দশা লাঘব করার আন্তরিক ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ যত দিন পর্যন্ত নেওয়া না হচ্ছে, তত দিন সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপেই চালকলমালিকদের দৌরাত্ম্য থামবে না। ধানচাষিদের দুর্দশা লাঘবের উপায় সরকারের নির্ধারিত দামে সরাসরি তাদের কাছ থেকেই ধান কেনার চলমান অকার্যকর ব্যবস্থাটি কার্যকর করা
কী ব্যাপার? আমদানি শুল্ক কমানো হলো চালের, দাম কমলে চালের দামই আগে কমার কথা; তারপর সেই প্রভাবে ধানের দামও কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু দেশের সব বাজার থেকে খবর এল, দাম কমেছে ধানের; চালের দাম একটি পয়সাও কমেনি।
এ কেমন কারবার? এর রহস্য কী?
এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। এর জন্য গবেষণার দরকার হবে। তবে গবেষণা ছাড়াই, স্থূল চোখেই যে বিষয়টা ধরা পড়ে তা হলো, চালের উৎপাদন ও বিপণনের পুরো প্রক্রিয়াটি এখন আর কৃষকদের হাতে নেই। ধান কেটে ঘরে তোলার পরেই ধানচাষির ভূমিকা ফুরিয়ে যায়। এক মণ ধান ঘরে তুলতে তাঁর কত টাকা খরচ হয়েছে, কত ঘাম ঝরেছে—এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাঁকে ধান বিক্রি করতে হয় বাজারে প্রচলিত দরে, যে বাজার চলার কথা মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বতঃস্ফূর্ত নিয়মে। কিন্তু বাংলাদেশের ধান–চালের বাজারে স্বতঃস্ফূর্ততা অসম্ভব; কারণ, তা কতিপয় গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের শিকার। আসলে ধানের কোনো ভোক্তা নেই, ভোক্তা আছে চালের। ধানের ক্রেতা মূলত চালকলমালিকেরা। এ দেশের ধানচাষিদের হাত–পা বাঁধা পড়েছে তাঁদের হাতে। এই মালিকেরা একই সঙ্গে চালের ব্যবসায়ীও বটে।
তো খাদ্যমন্ত্রী যখন ঘোষণা করলেন যে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তার এক দিন পরেই (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করার আগেই) নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া ও রংপুরে প্রধান হাটগুলোতে চালকলের মালিকেরা ধান কেনা কমিয়ে দিলেন। ধানচাষিরা অসহায়; কারণ, চালকলগুলোর মালিকেরাই তাঁদের ধানের প্রধান ক্রেতা; তাঁরা ধান না কিনলে কিংবা কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিলে ধানচাষিদের লোকসান গোনা আর হতাশায় ভোগা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
ধানের দাম কম অথচ চালের দাম বেশি—এর মানে ধানচাষিকে কম দামে ধান বিক্রি করে বেশি দামে চাল কিনে ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়; সেই জীবন ক্ষয় করে পরের মৌসুমে আবার ধান চাষ করতে হয়। ধানচাষির দুঃখ–কষ্টের এই গোলমেলে ব্যাপারটা সম্ভবত আমরা নগরবাসী ভদ্রলোকেরা বুঝতে পারব না। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগবে: যে চাষি ধান ফলান, তাঁকে চাল কিনে খেতে হবে কেন? তিনি কি নিজের ফলানো ধান থেকে নিজেই চাল বানাতে পারেন না?
মোটা দাগে এই প্রশ্নের উত্তর, না। ধান থেকে চাল বানানোর জন্য ধান শুকানোর জায়গা দরকার, বিপুল পরিমাণ ধান সেদ্ধ করার বন্দোবস্ত দরকার, কলে ধান ভাঙানোর জন্য পয়সা দরকার। বাংলাদেশে এখন বড় কৃষকের সংখ্যা খুবই কম; বেশি জমির মালিকেরা নিজেরা ফসল ফলান না, ছোট চাষিদের জমি পত্তন বা লিজ দেন। ছোট চাষিদের নিজেদের জমি কম; তাঁদের ঘরবাড়ি ছোট, বাড়ির উঠান ছোট, চুলা ছোট, চুলার জ্বালানি সংগ্রহের সামর্থ্য কম। ফলে তাঁদের ধান ফলিয়ে বিক্রি করতে হয়। তাঁরা সরাসরি সরকারের কাছেই তা বিক্রি করতে চান। সরকারও ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘সরাসরি’ তাঁদের কাছ থেকেই ধান কেনার ‘অভিযান’ শুরু করে।
কিন্তু ধানচাষিরা ধোঁকা খান। খাদ্য বিভাগের লোকেরা তাঁদের বলেন, ‘তোমার ধান ভিজা’। সরকার বাহাদুর ‘ভেজা ধান’ কিনতে নারাজ। তাই ধানচাষিদের শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে: ধানের আর্দ্রতার মাত্রা ১৪ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু ধানচাষির ধান শুকানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই; ধান রাখার জায়গাও কম। তাই তিনি ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিক্রি করতে চান। এটা তাঁকে করতে হয় আরও এই কারণে যে ধান বিক্রি করেই সেচের পানির বকেয়া বিল শোধ করতে হবে, সার–কীটনাশকের দোকানির পাওনা শোধ করতে হবে; ধারকর্জ নেওয়া থাকলে তা–ও শোধ করতে হবে। সরকারের কাছে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে চালকলমালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করা ছাড়া তঁাদের কোনো পথ থাকে না। চালকলের মালিকেরা সেই চাল নিজেদের চাতালে শুকিয়ে কিছু সরকারের কাছে বিক্রি করে বাকিটা চাল বানিয়ে বিক্রি করেন।
এইভাবে তাঁদের দ্বারাই ধান–চালের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। তাঁদের এই নিয়ন্ত্রণক্ষমতা এতই প্রবল যে সরকারকেও তা বেকায়দায় ফেলে দেয়। এবার সরকারের বেকায়দা অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, ধানের দাম কমলে চালের দামও কমানো উচিত। লক্ষ করুন, মন্ত্রী বলেননি ‘কমে যাওয়া উচিত’, বলেছেন ‘কমানো উচিত’। অর্থাৎ চালের দাম বাড়া কিংবা কমা বাজারের স্বতঃস্ফূর্ত আচরণের ওপর নির্ভরশীল নয়, চালকলমালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মন্ত্রী তাঁদের হুমকি দিয়েছেন এই বলে, ‘এত দিন তাঁরা চাল বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করেছেন। এখনো যদি তাঁরা চালের দাম না কমান, তাহলে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর হবে।’
চালের দাম যে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে, তা যদি মন্ত্রীর এই হুমকির পরেও না কমে, তাহলে সরকার কীরূপে কঠোরতা প্রদর্শন করবে, সে ব্যাপারে আমরা কৌতূহলী। এই ফাঁকে বলি, ধানচাষিদের দুর্দশা লাঘব করার আন্তরিক ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ যত দিন পর্যন্ত নেওয়া না হচ্ছে, তত দিন সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপেই চালকলমালিকদের দৌরাত্ম্য থামবে না। ধানচাষিদের দুর্দশা লাঘবের উপায় সরকারের নির্ধারিত দামে সরাসরি তাদের কাছ থেকেই ধান কেনার চলমান অকার্যকর ব্যবস্থাটি কার্যকর করা। সে জন্য ধানের ন্যূনতম আর্দ্রতার শর্ত তুলে নেওয়া এবং সরকারি খাদ্যগুদামগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক ধান শুকানোর যন্ত্রের ব্যবস্থা করা।
● মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক
mashiul.alam@gmail.com