ধানখেতে অট্টালিকা

আমার প্রিয় জন্মভূমি চট্টগ্রাম। মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে রাউজানের হলদিয়া ইউনিয়নে ছোট-বড় টিলার বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ চমৎকার এক গ্রাম ইয়াসিননগর। ফসলের ঘ্রাণ, শিশিরভেজা ঘাস, সবুজ পাতার সৌরভ, ছোট ছোট প্রস্রবণ, উঁচু-নিচু টিলা আর ঝোপঝাড়ের সৌন্দর্যে অনন্য। সমতল ভূমির মধ্যে ছোট ছোট টিলা থেকে ক্রমেই উচ্চতায় পাঁচপুকুরিয়া, বৃন্দাবনপুর, কাউখালী হয়ে রাঙামাটির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা।
আমার গ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য মাটির ঘর। প্রবল বর্ষা বা ঝড়ে এসব ঘর ধূলিসাৎ হয়নি। আমার পিতামহ ভূগোলশাস্ত্রের খ্যাতিমান শিক্ষক রুহুল আমীন চৌধুরী সপরিবারে এই মাটির ঘরে ৮৭ বছর জীবন কাটিয়েছেন। ব্রিটিশ যুগের গ্র্যাজুয়েট হয়েও শ্রম ও ঘামে ভরা ছিল তাঁর জীবনধারা। শীত ও গ্রীষ্মে খোলা রোদ ও হাতপাখাই ছিল তাঁর প্রকৃতিনির্ভর জীবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। মাটির ঘরে দেখেছি তাঁর সৎ জীবনের কষ্টসহিষ্ণুতা, মিতব্যয়িতা। মাটির এ ঘর ভেঙে সুরম্য ভবন তৈরির সক্ষমতা ও মানসিকতা আমাদের নেই; বরং পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া শতবর্ষী শ্বেতগোলাপ ও কাঁঠালগাছ অক্ষত রেখেছি। এ গ্রামে টিলার ওপর বা উঁচু জমিতে ছিল জনবসতি।
সম্প্রতি আবাদি জমিতে ভবন নির্মাণের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে নিসর্গ। সময় ও সমাজ বদলেছে। তাই অর্থবিত্তের প্রবল ঢেউয়ে মানুষ পড়েছে অট্টালিকা তৈরির মোহে। আমার বাড়ির সামনেই খোলা মাঠের পাশে সবুজ ধানখেতের বুকে গড়ে উঠছে এক অট্টালিকা। তার পাশেই শোভা পাচ্ছে এক মুঠোফোন কোম্পানি সুউচ্চ টাওয়ার। নগরায়ণের পথ বেয়ে প্রকৃতি ধ্বংসের এ প্রক্রিয়া এখন দানবীয় শক্তিতে গ্রাস করছে পুরো গ্রামকে। এ গ্রামে অনাবিল সৌন্দর্যের আধার নেটটিলা। আনন্দ-বিনোদনে মুখর এ বিশাল টিলাকে এখন জনবসতি গিলে খাচ্ছে। ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে অতুলনীয় সৌন্দর্যের কানন নেটটিলা। প্রকৃতির সঙ্গে নিষ্ঠুর বৈরিতায় গ্রাম হচ্ছে সর্বহারা। এভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে দুই লাখ হেক্টর কৃষিজমি নগরায়ণ ও শিল্পায়নের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৮৮ সালের মধ্যে দেশ কৃষিভূমিশূন্য হয়ে পড়বে। এরপর কোথায় যাবে খাদ্যনিরাপত্তা? কোথায় যাবে কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকা?
প্রকৃতিনির্ভর গ্রামীণ জীবনে নির্লোভ-নির্মোহ সরলতায় আঘাত হানছে নগরজীবনের স্বার্থপরতা। নির্বাসিত হচ্ছে পারিবারিক বন্ধনের মায়া-মমতা। কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ বড় বড় শহরের মতো গ্রামেও সৃষ্টি করবে অনিয়ন্ত্রিত জলাবদ্ধতা ও পরিবেশদূষণের ভয়াবহতা। নগরের অট্টালিকায় খাঁচার পাখির মতো বন্দী মানুষ মুক্ত বাতাসে বিচরণ, সবুজের মধ্যে অবগাহন ও পুকুরে সন্তরণের জন্য গ্রামে যায়। সেই গ্রামকে ইট-পাথরের নগর করার বিষময় ফল হবে অসংখ্য ইটভাটার প্রসার ও অগণিত গাছপালা উজাড়। গ্রাম ধ্বংসের বিনিময়ে আমরা নগর পাব, কিন্তু দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ পাব না।
পরিবেশ সমীক্ষায় দেখা গেছে, যানবাহন ও জ্বালানির পর কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী ভবন। বিশ্বজুড়ে কার্বন হ্রাসের পদক্ষেপের ঠিক বিপরীতে চলছি আমরা। মাটিতে নির্বিচারে পাকা দালান উঠলে মাটিভিত্তিক ‘সফট সারফেস এলাকা’ কমে মাটির তাপমাত্রা শোষণের ক্ষমতাও কমবে। এতে উষ্ণতাকবলিত হবে গ্রাম। বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডে সুউচ্চ ভবনে কৃষি খামার গড়ে তুলে সবুজায়ন এবং জাপান ও চীনে ছাদে বৃক্ষরোপণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চীনে কেউ যদি ১ দশমিক ৩৩ হেক্টর বা তার বেশি পরিমাণ আবাদি জমি ধ্বংস করে, তবে তার পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। কৃষিজমি ধ্বংস করার অপরাধে চীনে ৫০ হাজার ইউয়ান (আট হাজার ডলার) জরিমানার বিধান আছে। বাংলাদেশে কৃষিজমি সুরক্ষার খসড়া আইনটি দ্রুত কার্যকর করে জেল-জরিমানার বিধান চালু করলে আপাতত বেপরোয়া এ ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকানো সম্ভব হবে।
রেমিট্যান্সের অর্থ উৎপাদনমুখী না হয়ে ভোগবিলাসে ব্যয় হচ্ছে। প্রবাসীরা কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করছেন গ্রামে সবুজ ধানখেতের ওপর আবাসিক ভবন, মার্কেট ও ইটভাটা নির্মাণে। এতে লাফিয়ে বাড়ছে জমির মূল্য। গ্রামের মানুষ কৃষি থেকে সরে যাচ্ছে, অকৃষি খাতে বিনিয়োগ করছে অনেক মুনাফার লোভে। যেকোনো ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের আগে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার যে বিধান ১৯৯০ সালের ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালে আছে, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
আমাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে এখন অপচয় ও অপব্যয় ছড়িয়ে গেছে। অর্থের ওজনে মাপা হচ্ছে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা। ফলে সবুজ ধানখেতে শোভা পাচ্ছে সুরম্য অট্টালিকা, সেখানে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক জীবনের সাজসজ্জা। এসব সুদৃশ্য ভবন দেখিয়ে বাড়ানো হয় তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা। আলিশান ভবন মানেই উন্নত জীবনমান নয়। গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, সেতু, সড়ক, কালভার্ট হলে তা জীবনমান বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক। কিন্তু বৃক্ষলতা, আবাদি জমি, খাল, বিল ও টিলার সমাধি রচনা করে অট্টালিকা নির্মাণ ‘উন্নয়ন তত্ত্বে’র আওতায় পড়ে না।
নগরায়ণ প্রত্যাশিত একটি পরিবর্তন প্রক্রিয়া, তবে নগরায়ণের নামে অট্টালিকার নিচে চাপা পড়ছে সবুজ গ্রাম। গ্রাম আমাদের মুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের স্থান, কৃষি অর্থনীতির প্রাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপান। তাই গ্রামে নগরায়ণ হতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত ও পরিবেশসম্মত। নগরায়ণের গতিকে সঠিক পথে রাখতে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের শক্ত ভূমিকা নিতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে। রেমিট্যান্সের স্রোতকে সঠিক পথে প্রবাহিত করতে হবে। দুই বা তিন ফসলি আবাদি জমিকে সুনির্দিষ্ট ‘কৃষি-অঞ্চল’ ঘোষণা করে এর শ্রেণি পরিবর্তন (শিল্পায়ন/নগরায়ণ) নিষিদ্ধ করুন। সুপরিকল্পিত পল্লি অবকাঠামোর আওতায় সবুজ প্রকৃতি ও বনবনানী অক্ষত রেখে গ্রামগুলো সমবায় কৃষি খামার ও উন্নত জাতের গাভির খামারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করুন।
বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য সবুজ গ্রাম এবং ধানখেতের বুকে আঁকাবাঁকা মেঠো পথটি যেন হারিয়ে না যায়। আমাদের শেষ গন্তব্য সমাধি অভিমুখে, সুরম্য প্রাসাদে নয়। সুতরাং, বিত্তশালীদের অর্থ যেন অট্টালিকা তৈরির স্রোতে ভেসে না যায়।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
mmunirc@gmail.com