মতামত

ধর্ষণ বন্ধে চারটি জরুরি সমাধান

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

জাতিসংঘ নারী সংস্থা বা ইউএন উইমেন ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘ধর্ষণচর্চার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ১৬টি উপায়’। প্রতিবেদনটির শুরুতে কয়েকটি হাইপোথিসিস বা অনুসিদ্ধান্ত আছে। সেগুলোতে নতুনত্ব বা গভীরতা তেমন নেই অবশ্য। মানুষের সহজাত ভাবনার পুরোনো গৎ, পুরোনো বয়ানকে দায়ী করা হয়েছে তাতে। যেমন জনমানস এ রকম: ‘ছেলেরা তো ছেলেই’ (ব্যাটাগিরি, মর্দামি দেখাবেই)। ‘ধর্ষিতা নেশাগ্রস্ত ছিল’ (পশ্চিমা সমাজের ছুঁতো)। নারীর ‘না' বলা আসলে হ্যাঁ বলা’ (অর্থাৎ যুগল সম্পর্কের যৌনতার বেলায় পুরুষ নারীর অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না)। বোঝা সহজ, প্রতিবেদনটি সারা দুনিয়ার বাস্তবতার একেকটি দিকে আলো ফেলতে চেয়েছে। প্রথমত, ‘পুরুষতন্ত্র’ আসলেই সমস্যা। দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্তের সারকথা, পুরুষ নারীকেই দোষারোপ করে। রক্ষণশীল দেশগুলোতে যেমন ‘পোশাক ঠিক ছিল না’ ছুঁতো বড় করে দেখা হয়—অনেকটা সেই রকম। তৃতীয়টির অর্থ হলো, বৈধ-আইনসিদ্ধ সম্পর্কেও (যেমন বিবাহ, প্রেম) নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এই বয়ান বাংলাদেশেও সম্প্রতি মনোযোগ পাওয়া শুরু করেছে।

জাতিসংঘ নারী সংস্থার পরামর্শের ১৬টি পদ্ধতির উল্লেখের আগে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়ার দিকে খানিকটা আলো ফেলা দরকার। এই সময়ে জনপ্রতিক্রিয়া বুঝতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় সহায়ক। পত্রিকাগুলোও খবরের নিচে এখন পাঠক মতামত ছাপে। সেগুলোতেও নজর রাখা প্রয়োজন। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের গণধর্ষণ এবং খাগড়াছড়িতে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর হাজারখানেক মন্তব্য দেখেছি। তার মধ্যে দু-একটি বাদে প্রতিটি মন্তব্যেই ধর্ষকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। কয়েক দিন আগেও যাঁরা সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ার নির্মূল হোক চেয়েছিলেন, তাঁরা ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে মৃত্যু চাইছেন। অজস্র মতামতদানকারী আইনত অন্যায্য দাবিও করছেন। যেমন রাস্তায়, প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে ফাঁসি কার্যকর করা হোক। মূল বক্তব্য, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।

ক্রসফায়ার বা জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া আসলে সত্যি সত্যিই চাওয়া নয়। সেগুলো চরম ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশের একধরনের রূপক প্রকাশভঙ্গি মাত্র। এই হাজারখানেক মতামতের মধ্যে পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করা কয়েকটি মন্তব্য থাকলেও ‘পোশাকের বা চালচলনের দোষ’ কথাটি একবারও পাইনি। ঘুরেফিরে ৯৯ ভাগ মতই শুধু কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছে। এক নম্বরেই দায়ী করা আছে ‘ক্ষমতার রাজনীতির সংস্রব’কে। বেশির ভাগ মতই এ রকম: ক্ষমতার রাজনীতিতে লেগে থাকার বড় লাভ ‘ইম্পিউনিটি’ বা অপরাধের দায়মুক্তি। ফলাফল সুবিচারের অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাজনৈতিক শক্তির বশ্যতা ইত্যাদি।

লক্ষণীয় যে জাতিসংঘ নারী সংস্থার ১৬টি পরামর্শের অন্যতম ছিল গুরুত্বপূর্ণটিও ‘ইম্পিউনিটি’ বা দায়মুক্তির বিপক্ষে দাঁড়ানোর বিষয়ে। বলা হয়েছে, ‘এন্ড ইম্পিউনিটি’ বা ‘দায়মুক্তির সমাপ্তি’ ঘটাও।

‘কে আমার কী করতে পারবে, দেখি’—সরকারে থাকা দলের কর্মীদের এই ভাবনার সঙ্গে আমাদের সবার নানাভাবেই পরিচয় ঘটে গেছে। আমরা দেখেছি, যুগে যুগে সরকারপন্থী ছাত্রদের একাংশ ছাত্র না হয়ে গুন্ডা হয়, ধর্ষক হয়, ডাকাত হয়। কেন হয়? দায়মুক্তির সুযোগ থাকায় হয়। পেশির জোরের কারণে হয়। পেশি বা ইংরেজি ‘মাসল’ মানে শুধুই গায়ের জোর নয়। ‘মাসল’-এর অর্থ ক্ষমতার জোর। দল ক্ষমতায়, ফলে ‘যা ইচ্ছা তা-ই করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে’ বিশ্বাসের জোর। সিনিয়র নেতারা, যাঁরা ছাত্রদের স্বীয় স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেন, তাঁদের আশকারা ও মদদের জোর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নীরব থাকার জোর।

অস্বীকার করার উপায় নেই, ধর্ষণ বাংলাদেশে একটি সর্বব্যাপ্ত অপরাধ হতে চলেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর গড়ে প্রতি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১১ জন নারী। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। ২০১৭ সালে ৮১৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৭৬ জনকে। আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছিলেন ১০ জন নারী।

এসব সত্যকে আমলে নিয়েও বেশির ভাগ মন্তব্যকারীরই মতামত এ রকম, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো অপরাধে ছাত্রদেরও জড়িয়ে পড়া মানে আশার শেষ আলোটিও নিভে যাওয়া। তারপর হতাশা আর ভীতি ছাড়া অন্য কোনো অনুভব বা আশাবাদের সুযোগ থাকে না। কোথায় ছাত্রসমাজ ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, উল্টো তারাই কিনা ধর্ষণে জড়িত!

ওই ছাত্ররা কেন ধর্ষণে নামবে?

কারণ, তারা রাজনীতি-পরিচয়কে অপরাধের অস্ত্র ও শাস্তি ঠেকানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তারা জানে, পুলিশ, আইন, বিচার প্রভৃতি সবকিছুই তাদের ক্ষমতার কাছে নতজানু। তারা জানে যে এসব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার চোখ রাঙিয়ে সটকে পড়া যাবে। তাই তারা অনায়াসে নানা রকম অপরাধে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছাড়ে না। বেপরোয়াপনা ও ‘মাসল পাওয়ার’ দেখানোর আরও নেপথ্য কারণ আছে। তালিকা লম্বা করে লাভ নেই। ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের ধর্ষণকাণ্ড লিখতে গেলে কয়েক খণ্ড গ্রন্থ রচিত হয়ে যাবে। ধর্ষণকাণ্ডের অধিকাংশই খবরে আসে না। ধর্ষণের শিকার নারীরা সাধারণত ভয়েই ঘটনা প্রকাশ করেন না। এসব সমস্যা ছাপিয়ে ছিটেফোঁটা যে দু-একটি খবর প্রকাশিত হয়, সেগুলোর কয়েকটি দিয়েই অপরাধীদের দায়মুক্ত থাকার নমুনা টের পাওয়া যায়।

সিলেটের এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় এক-দুজন নয়, নয়জন জড়িত। কতটা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র হলে এমনটি হওয়া সম্ভব? উল্লেখ্য, পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ধর্ষকদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক মুরব্বিরা আপসরফা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন? সরাসরি পুলিশের হাতে ধর্ষকদের তুলে দেওয়াই কি তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল না? ধর্ষকদের মুরব্বিদের পরোক্ষ ধর্ষক বা ধর্ষণে প্ররোচক বললে ভুল বলা হয় কি?

১৯৯৩ সালের ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা সীমান্ত, মিতুল, জাপানসহ কয়েকজন মিলে এক ছাত্রীকে অপহরণ ও লাঞ্ছনা করেন। সেই সময়ের তথ্যমন্ত্রীর লজ্জা বা গ্লানি হয়নি সম্ভবত। হলে কি আর ছাত্রীর বাবাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডেকে সমঝোতা করিয়ে দিতে পারতেন? ওই ছাত্রীর ‘দ্বিতীয় নির্যাতন’ সেখানেই ঘটে যায়নি কি? আর কোনো দিনই ক্যাম্পাসে ফেরেননি সেই ছাত্রী। ছাত্রীর বাবার কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাস চত্বর ছেড়ে যাওয়ার ছবি দেখেই আমাদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু সেই ছাত্ররা ঠিকই ডিগ্রি নিয়ে সগর্বে ক্যাম্পাসজীবন শেষ করেন।

পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরির ঘোষণা দেন। সেই ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিবাদে উত্তালও হয়ে ওঠে। ২০০০ সালে থার্টিফার্স্ট নাইটে ক্ষমতাসীন দলের একদল ছাত্রনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেন। সেবারও তাঁদের অপরাধে উল্টো শাস্তি মেলে ছাত্রীদেরই। থার্টিফার্স্ট নাইটে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ২০১৭ সালে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের ছাত্রলীগের এক নেত্রী নিজ সংগঠনের সভাপতির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে দেন।

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে ধর্ষণসংক্রান্ত একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। একজন আমাকে বলেছিলেন, সহজে বলেন তো এই সমস্যার সমাধান কী আদৌ সম্ভব, কীভাবে সম্ভব? উত্তরে বলেছিলাম, এক. ধর্ষকদের গায়ের রাজনীতির পোশাকটি (পরিচিতি) সরিয়ে ফেলুন বা পরতে দেবেন না। তাতেই ধর্ষণের সংখ্যা ৯০ ভাগ কমে যাবে। দুই. ইম্পিউনিটি, ‘আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকব, ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে আমার সংযোগ আছে’ এ রকম ভাবার সুযোগ বন্ধ করে দিন। আরও ৫টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। তিন. ক্ষমতার রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়া নারীরা রাজনীতির সুবিধাভোগী হয়ে এই দুই শ্রেণির দুষ্কর্মে নীরব থাকবে না, তা নিশ্চিত করুন, আরও ৪টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। চার. বাকি যে এক ভাগ ধর্ষক, ধরা যাক, হ্যাবিচুয়াল রেইপিস্ট বা স্বভাবগত যৌন অপরাধী, তারা দুষ্কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে। এমনকি আক্রান্ত নারীরাই তাদের কাবু করে ফেলতে পারবে। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যদি তাদের আস্থা জন্মায় যে দেশের মানুষ রাজনীতিকে ব্যবহারকারী গুন্ডাদের আর ভয় পাচ্ছে না।

রাজনীতিকে ঢাল বানানো ধর্ষকদের যেকোনো রকম দায়মুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ এবং রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।