‘প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙীন পাখা’—দুই বেণি ঝুলিয়ে প্রজাপতি মেয়েশিশুগুলো এমন গান গায়। প্রজাপতির মতোই নেচে নেচে বেড়ায়। মা-বাবা স্বপ্ন দেখেন, মেয়ে একদিন প্রজাপতির মতোই পাখা মেলবে। উড়ে বেড়াবে আকাশে। পৌঁছে যাবে সাফল্যের শিখরে। কিন্তু ওড়ার আকাশটা যখন কালো মেঘে ঢাকে, তখন? আদরের ছোট্ট প্রজাপতিকে কি সে আকাশে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে? মেঘের সঙ্গে টক্কর টক্করে যদি তার পাখা ভেঙে যায়? মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে? তবে কি প্রজাপতি ঘরেই বন্দী থাকবে? তাহলে তো সে আর উড়তে শিখবে না। শুঁয়োপোকা হয়েই কেটে যাবে প্রজাপতির জীবন। তবে উপায় কী?
ছোট ছোট প্রজাপতি মেয়েশিশুর মা-বাবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এমন সব প্রশ্ন। উত্তর মিলছে না। চারপাশের সমাজটা তো এখন কালো মেঘে ঢাকা আকাশের মতোই। সেখানে একের পর এক ধর্ষণের শিকার হয় শিশু থেকে কিশোরী, তরুণী, নারী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনে শিশু ধর্ষণের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। আসকের হিসাবে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এগুলোর অর্ধেকের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স বলা আছে। দেখা যায়, তাদের সিংহভাগেরই বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বছরওয়ারি হিসাবের ভিত্তিতে বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৮৩ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৩ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশুর তালিকায় আরেক নাম সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তার সায়মা। ৫ জুলাই উদ্ধার করা হয় সায়মার লাশ। তাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ফেসবুকে ঘুরছে ফুটফুটে সায়মার ছবি। প্রজাপতির পাখনা লাগানো জামা পরা। হাসিমাখা টুলটুলে মুখ। হয়তো সে মাকে বলত, আমি ডাক্তার হব। হয়তো বলত বিজ্ঞানী হব। এর কোনোটাই হয়নি। একই ভবনের বাসিন্দা মাথার ওপরে বসে থাকা ধর্ষকের শিকার হয়েছে সায়মা। তেলাপোকার জন্য রান্নাঘরের সিংকটার কাছে যেতে হয়তো ভয় পেত মেয়েটি। সেখানেই ধর্ষক রেখে দিয়েছিল সায়মার লাশ। সাদা কাপড়ে মোড়া সায়মার ছোট্ট লাশের ছবিও ঘুরেছে ফেসবুকে। মা-বাবারা কি সেখানে নিজের আদরের মেয়েটির মুখ দেখছেন?
মেয়েকে কত–কী বানাতে চাই আমরা। প্লে স্কুলে ভর্তি। সেখান থেকে শুরু হয় স্বপ্ন বোনো। স্কুলে পড়াশোনা, নাচ, গান, সাঁতার—কোনোটাই তো বাদ রাখে না কেউ। সব জায়গাতেই তো ছড়িয়ে আছে বিপদ। কে বলতে পারে পড়ার বা গানের শিক্ষকটি ছোট্ট মেয়েটিকে শিকার বানাবেন না? সচেতন অভিভাবকেরা সেখানে বসে থেকে মেয়েকে পাহারা দেন। প্লে থেকে উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি মাস্টার্সের পরেও পাহারা শেষ হয় না। বিয়ের পরে বোধ হয় পাহারার দায়িত্ব নেন স্বামী।
কিন্তু বিপদ থেকে বাঁচাতে এই যে আগলে রাখা, তাতে কি সমাধান আসে? মেয়েটি কি তাতে নিজেকে সুরক্ষিত করতে শেখে কোনো দিনও?
প্রতিবেশী এক মায়ের কথা বলি। মেয়ে রোজ বাড়ির পাশের মাঠে খেলে। সায়মার ঘটনা শোনার পর থেকে তিনি আতঙ্কে আছেন। মেয়েকে খেলতে পাঠাবেন না পাঠাবেন না? তাঁর আতঙ্ক অযৌক্তিক নয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, খেলাধুলা ছাড়া শিশুমনের বিকাশ ঘটে না। তবে ধর্ষকদের ভয়ে খেলাও কি বন্ধ হবে? খেলার মাঠেও সব শিশুকে অভিভাবকেরা তাঁদের পাহারা দেবেন? কর্মজীবী অভিভাবকদের পক্ষে সেটা কি সম্ভব?
সায়মার ঘটনার পর কথা হয় মেয়েশিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে। কেউ ভয়ে মেয়েকে কারও সঙ্গে মিশতে দিতে চান না। কেউ যেখানেই মেয়েকে পাঠান, পাহারা দিয়ে রাখতে চান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন, মেয়ে হয়ে জন্মানোই অপরাধ। মেয়েরা যেন আর না জন্ম নেয়। মেয়েশিশুদের অভিভাবকদের চোখেমুখে আতঙ্ক, চাপা ক্ষোভ।
বলা বাহুল্য, সমাজ তো আর আবেগে কান দেবে না। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে। কোনোটাতে আসামি ধরা পড়বে। কোনটায় পড়বে না। কোনোটার বিচার হবে। কোনোটায় হবে না। ধর্ষণ চলবেই। এ যেন অপ্রতিরোধ্য। রাতারাতি পুরুষের মানসিকতা বদলে যাবে—এমনটাও দুরাশা।
ধরে নিই, এই সমাজটা যুদ্ধক্ষেত্র। কোনো না কোনো পর্যায়ে জীবনযুদ্ধে আপনার মেয়েটিকে একা ছেড়ে দিতেই হবে। তাহলে যুদ্ধের জন্য মেয়েসন্তানকে প্রস্তুত করতে হবে আপনাকেই। মেয়েশিশুটিকে ধারণা দিন কোনটা ভালো স্পর্শ আর কোনটা খারাপ স্পর্শ। তাকে বলুন শরীরের কোন কোন জায়গা ব্যক্তিগত। কোনটা ঝুঁকিপূর্ণ। এ–সংক্রান্ত নানা ভিডিও ইন্টারনেটে সহজলভ্য। বলিউড তারকা আমির খানের একটি ভিডিও খুবই শিক্ষামূলক, যেখানে আমির খান সুন্দরভাবে শিশুদের বুঝিয়েছেন কোনটা ভালো স্পর্শ আর কোনটা খারাপ। শিশুকে এসব দেখান। মেয়েশিশু তাহলে আগে থেকেই সতর্ক হতে পারবে। এ রকম যৌন হয়রানি যদি কেউ করতে চায়, মেয়েশিশু কী করবে, তাও তাকে বলে রাখুন। চিৎকার দেবে। সেখান থেকে পালিয়ে যাবে। স্কুলে হলে শিক্ষক, খেলার মাঠে হলে কার কাছে যাবে, তাও বলে রাখুন। শিশুর সঙ্গে সম্পর্কটা এমন রাখুন, যাতে তার বিপদের কথা সে আপনাকে মনখুলে বলতে পারে। ভয়ের হোক, লজ্জার হোক, শিশু যেন সমস্যা জানাতে পারে আপনাকে। শিশুকে বলুন, আদরের ছলে কেউ খারাপ স্পর্শ করলে যেন সে মা-বাবাকে জানায়।
ধরুন, ছেলে কোনো গৃহশিক্ষক আপনার মেয়েশিশুকে পড়ায়। প্রথম কাজই হবে শিশুকে বলে রাখা শিক্ষক তাকে ভালো স্পর্শ করে না খারাপ? গৃহশিক্ষক কীভাবে আপনার শিশুকে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে, সে ধারণাও দিন তাকে। খারাপ স্পর্শ করলে শিশু যেন আপনাকে বলে। সে কথাও শিশুকে বলে রাখবেন। আরও একটা বিষয় খুব জরুরি। ছোট ছোট মেয়েশিশুকে নাচ শেখান অনেকেই। এর চেয়ে অনেক বেশি দরকার কারাতে বা মার্শাল আর্ট শেখানো। এর কৌশলে মেয়েশিশু প্রাথমিকভাবে নিজেকে সুরক্ষিত করতে জানবে। শিশুর মনোবল বাড়ানোর দায়িত্বটাও কিন্তু আপনার। তাকে প্রতিবাদী হতে শেখান। সমস্যার মোকাবিলা করতে শেখান। চুপ করে সহ্য করতে বলবেন না। চুপ করে থাকাই ভালো মেয়ের লক্ষণ—এই গৎবাঁধা চিন্তা থেকে তাকে সরিয়ে আনুন।
মেয়েশিশুর পাশে অভিভাবকেরা অবশ্যই থাকবেন। তবে তা যেন আগলে রাখা না হয়। বরং তাকে এমনভাবে গড়ে তুলুন, যেন সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। বিপদের মোকাবিলা করতে পারে। সমাজে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করুন আপনার মেয়েকে। যেন সে জোর গলায় বলতে পারে, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’ জীবনের সব ক্ষেত্রে, সব পর্যায়ে আপনি মেয়েকে ছায়া দিয়ে রাখতে পারবেন না। আদরের প্রজাপতিটাকে লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে। তবেই না সে পাখা মেলবে আকাশে।
শুভা জিনিয়া চৌধুরী: সাংবাদিক
ই–মেইল: shuva.chowdhury@prothomalo.com