জনপ্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে
জনপ্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে

ধর্ষকেরা কি মৃত্যুদণ্ডের পরোয়া করে

বাংলাদেশে ধর্ষণের মচ্ছব গত মাসে এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে ব্যাপক জনপ্রতিবাদের মুখে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধর্ষকদের বিচার করার জন্য যে আইন আছে, সেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে’ সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। আগে ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান। সংশোধনের পর আইনটি এখন বলছে: তুমি যদি ধর্ষণ করো, তাহলে তোমাকে ফাঁসিতে লটকানো হবে।

এই খবর সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্ষকেরা বোবা-কালা নয় যে এ খবর তাদের কাছে পৌঁছাবে না। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। ১৩ অক্টোবর থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর হয়েছে, তার পরের এক মাসে, অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে আগের এক মাসের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি। এই হিসাব করা হয়েছে শুধু প্রথম আলোর মুদ্রিত সংস্করণে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে। এই সময়ে ১৭১টি ঘটনায় ১৮৩ জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর বাইরে সারা দেশের আনাচে-কানাচে আরও কত ধর্ষণ ও নারীর প্রতি অন্যান্য সহিংস অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।

শাস্তি আরও কঠোর করার পর ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার এই চিত্র দেখে প্রশ্ন জাগছে: ব্যাপারটা আসলে কী হতে পারে? কোথায় ধর্ষণ কমবে, উল্টো আরও বেড়ে গেল। কেন? এটা কি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার প্রতিবাদ? ধর্ষকেরা কি এভাবেই জানান দিচ্ছে যে তারা এই মৃত্যুদণ্ড মানে না এবং কখনো মানবে না? কিন্তু তা-ই বা কী করে হবে। ধর্ষকেরা তো একটা সংগঠিত দল নয় যে মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে তারা দল বেঁধে ধর্ষণ করতে নেমে পড়েছে।

এই ধারায় ভাবতে গেলে আইন সংশোধনের পর এক মাসে ধর্ষণের ঘটনা এত বেশি হারে বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। বিষয়টির অনেকগুলো দিক থাকতে পারে। যেমন এক. সংবাদমাধ্যমের বিশেষ নজর, যাতে ধর্ষণের কোনো ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে না যায়। ফলে প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে এই সময়ে ধর্ষণের ঘটনাগুলো অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্ব ও জায়গা পেয়ে থাকতে পারে। দুই. শাস্তি বাড়ানোর পর বিচার পাওয়ার ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা বেড়ে গিয়ে মামলা করার প্রবণতা বেড়ে থাকতে পারে। মামলার সংখ্যা বেশি হলেই পরিসংখ্যান বাড়ে।

ধর্ষণের মামলা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে একপর্যায়ে মন্তব্য করেছেন, ‘একেবারে ছোট শিশুকে ধর্ষণের যেসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসছে, তাতে আমার খটকা লাগে। বলছি না সেসব মিথ্যা। অনেক সময় জমিজমার বিরোধেও ধর্ষণের মামলা দেওয়া হয়। সেসব খতিয়ে দেখা দরকার।’

ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের এই যখন অবস্থা, তখন তারা কি মৃত্যুদণ্ডের পরোয়া করবে? করছে না। এ দেশে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’র শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে

আমরা সাংবাদিকতার কাজে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে থানা-পুলিশের অনেক সদস্যের মুখে শুনেছি, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর একটা অংশ জমিজমাসংক্রান্ত ও অন্যান্য বিরোধের জের ধরে হয়ে থাকে। আইনমন্ত্রী ও পুলিশের ওই সদস্যদের বক্তব্য সত্য হলে ধর্ষণ মামলার সংখ্যার ভিত্তিতে প্রকৃত ধর্ষণের চিত্র পাওয়া কঠিন। ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার বিরুদ্ধে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের একটা অংশের বক্তব্য এ রকম যে এর ফলে এই আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা বাড়তে পারে। আর অপরাধ বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ ও সমাজ-মনোবিজ্ঞানীদের অনেকেই বলেন, শাস্তির কঠোরতার সঙ্গে অপরাধ কমার সম্পর্ক নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেছেন, শাস্তি যত কঠোর হয়, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগের চলমান সংস্কৃতিতে শাহদীন মালিকের এই মন্তব্যের প্রতিফলন স্পষ্টভাবেই মিলবে।

ফলে প্রশ্ন জাগছে, ধর্ষণপ্রবণতার বাড়াবাড়ির প্রতিকার করতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে লাভটা কী হলো। কিংবা ক্ষতিই হলো কি না। ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে এই ভাবনা থেকে যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে বলে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগে মামলা করার প্রবণতা যদি বেড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সামাজিক পরিসরে শত্রুতা বাড়বে, আর বিচারিক ক্ষেত্রে মামলার পাহাড় আরও বড় হবে। আইনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করেছেন, প্রধান বিচারপতি যেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোকে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেন। এটা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় ও সময়োচিত অনুরোধ। তবে এই অনুরোধ রক্ষা করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আমাদের বিচারব্যবস্থার রয়েছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার যে দক্ষতা, সামর্থ্য, সততা ও আন্তরিকতা প্রয়োজন, আমাদের দেশে তার সামান্যই রয়েছে।

ফলে ধর্ষণের বিচার করে ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা যারপরনাই হতাশাব্যঞ্জক। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন দমন আইনের অধীনে দায়ের করা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মামলার পাহাড় জমে উঠেছে। প্রতি এক বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা। শাস্তি পাচ্ছে প্রতি এক হাজারে মাত্র ৪ দশমিক ৫ জন। অর্থাৎ সাজার হার মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ। এভাবে ৯৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ আসামিই খালাস পেয়ে যাচ্ছে।

ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের এই যখন অবস্থা, তখন তারা কি মৃত্যুদণ্ডের পরোয়া করবে? করছে না। এ দেশে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’র শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। এটা ধর্ষকদের অনুকূল সংস্কৃতি: রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব, সামাজিক প্রতিপত্তি, আইন প্রয়োগকারীদের একাংশের অনৈতিক চর্চা, উপরন্তু ‘ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র’ নিয়ে টানাটানি এই সংস্কৃতির কয়েকটি উপাদান। আর ধর্ষণের শিকার পরিবারগুলোর ওপর মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা রকমের চাপ প্রয়োগ সবারই জানা বিষয়। ধর্ষক নিজে যদি স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না-ও হয়, তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর সে সে রকম ছত্রচ্ছায়া খোঁজে এবং তা পেয়ে যায়।

এখানে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ কমানো সম্ভব হবে না।

মশিউল আলমপ্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক

mashiul.alam@gmail.com