সরকার চালাতেই হিমশিম খেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ে মোট ঘাটতি ছিল ৭২ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৬ হাজার কোটি। তা সত্ত্বেও পরবর্তী বাজেটে অনুদান বাদেই ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার ঘাটতি ধরে প্রায় সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকার একটা সুবিশাল ব্যয় পরিকল্পনা করে বসে সরকার। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, বাকিটা সরকারের পরিচালন ব্যয়। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রথম ছয় মাস বা জুলাই-ডিসেম্বরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অথচ এনবিআরকে গতবারের নিট আদায়ের চেয়ে এবার ৪৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ যা গত বছরের রাজস্ব প্রবৃদ্ধির মতোই গতানুগতিক।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে নতুন বছরে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮%। ফলে পরিচালনার খরচ বড্ড বেড়েছে। বাড়ানো হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আকার বাড়ছে উন্নয়ন ব্যয়ের। বাস্তবায়নে অতি দীর্ঘসূত্রতা থাকলেও বড় প্রকল্প তৈরিতে সরকারের রয়েছে বিপুল আগ্রহ। এদিকে অর্থবছরে ৭০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রথম ৫ মাসে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৬২ কোটি ডলার। সব মিলে সরকারের আয়ের উৎস একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে।
ব্যয় বাড়ালেও আয় কমে যাওয়ায় সরকার এক দশকে সর্বোচ্চ ধার করেছে এ অর্থবছরেই। চলতি অর্থবছরের জন্য ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছিল। অথচ অর্থবছর শুরু অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে গত ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়ে ফেলেছে ৪৯ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ মাসে ঋণ নেওয়া হয়েছিল আরও অনেক কম: ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। সরকারের ঋণ নেওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে তা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আয়ের তুলনায় ব্যয় যত বাড়ছে, সরকারও তত বেশি ঋণের ফাঁদে পড়ছে। গত অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরেও তা ছিল সাড়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের নেওয়া মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ১০ বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার খাতে। এতে দুর্নীতি না কমলেও ব্যয় বেড়েছে বিপুল। মোট বাজেটের ২৮ শতাংশই খরচ হয় বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে। আরেকটি বড় খাত হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধ, প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ।
এদিকে যারা ঋণ শোধ করতে না পারার ‘যৌক্তিক’ কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন, তাদের মোট ঋণের ২ শতাংশ এককালীন নগদ পরিশোধ করলে বাকি টাকা ৭ শতাংশ সুদে ১২ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরপরে দেখা গেছে, যারা ঋণখেলাপি ছিলেন না তারাও ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছে। বর্তমানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হিসাবের চেয়ে দ্বিগুণ, ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা যা মোট ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। এর সঙ্গে বাড়ছে অর্থ পাচার।
অর্থবছরের প্রথমার্ধে বৈদেশিক রপ্তানি ৫,২১% কমেছে, আমদানিও কমেছে ৫,২৬%। পুঁজিবাজারে আবারও বড় ধরনের ধস নেমেছে। সূচক সাড়ে চার বছরে সর্বনিম্নে এসে দাঁড়িয়েছে। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। ২০১০ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে। অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা যখন এমন, তখন ৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ‘ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদের বার্ষিক কার্যক্রম প্রণয়ন সম্মেলন ২০২০’ এ প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী বৈশ্বিক মন্দাভাবের উল্লেখ করে মন্তব্য করে বসেন, 'দেশের অর্থনীতি এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে'। এই স্বীকৃত খারাপ সময়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব দ্রুত একের পর এক সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে। টাকার মান অবনমন করার কথা বলেও পরে বাদ দেওয়া হয়েছে। সুদের হারে সীমা বসানো হচ্ছে (ঋণ ও আমানতের সুদহার যথাক্রমে ৯ ও ৬ শতাংশে নির্ধারিত)।
ঘোষণা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা আনা-নেওয়ার পরিমাণ ৫ হাজার ডলার থেকে দ্বিগুণ করে দশ হাজার ডলার করা হয়েছে। ব্যাংক আমানত সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে। ঋণ করে ঘি খাচ্ছে উন্নয়ন। সরকারি ঋণ আশঙ্কাজনক স্তরে উঠে যাচ্ছে। স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিতে আইন করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সম্ভবত কিছু ভুল করে বসেছে।
ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।
আরও পড়ুন: