২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে প্রায় দুই বছর চার মাস অতিবাহিত হতে চলেছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্ববাসী সোচ্চার হয়েছিল এবং রয়েছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের নিবাস রাখাইন (পূর্বতন আরাকান) থেকে যে পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে গত ২০ বছর ধরে উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, এমনকি জাতিসংঘের মতে জাতিগত নিধন এবং পরিকল্পিত গণহত্যা। সর্বশেষ নৃশংসতা ও গণহত্যার বাস্তবায়ন হয়েছে দুই বছর ধরে। শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। তবে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ভয়াবহ নৃশংসতার মধ্য দিয়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সমর্থনে এমন কোনো বর্বরতা নেই, যা রোহিঙ্গাদের ওপর চালায়নি। উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত তিন জেলায় কার্যত ভিটেবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে। যাদের প্রায় ১১ লাখ এখন বাংলাদেশে এবং কিছু অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। বাকি রোহিঙ্গারা রাখাইন অঞ্চলেই আবদ্ধ ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
বিগত দুই বছরে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল বিভিন্ন মুসলিম ও অন্যান্য দেশের সরকার, মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘ। বাংলাদেশ তাদের ওপর চাপানো এ সংকট সমাধানে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েও এগোতে পারেনি। যারা দৃশ্যত মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, তাদের মধ্যে চীন, ভারত, জাপান ও রাশিয়া কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রমাণিত নয়। বাংলাদেশ এরপরও মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সুসম্পর্ক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
এমনকি পর্দার অন্তরালে মিয়ানমারের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ এখন খুঁজছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কারণ, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকেরা, যাঁদের প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে, তাঁরা কোনোভাবেই ফেরত নেওয়ার পক্ষে নন। এ নিয়ে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই যে মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অং সান সু চি মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অপকর্মকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দ্বারা যে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে মাটিতে যেভাবে মেশানো হয়েছে, তা দেশটি কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখতে পারছে না। বিগত দুই বছরে বিশ্বের বহু দেশের স্বাধীন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের তদন্তে বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অনুরোধে মধ্য আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) তরফ থেকে জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে মামলা দাখিল করেছে। কাল ১০ ডিসেম্বর এর শুনানি হতে যাচ্ছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অভিযোগসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে গাম্বিয়া। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে শুনানির দিন ধার্য করে মিয়ানমারকে নোটিশ দিয়েছেন। মিয়ানমার জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে এ নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে সাফাই তুলে ধরতে বাধ্য।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর, একাধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রধান অং সান সু চি নিজে মিয়ানমারের এবং সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে আইসিজেতে হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তিনি নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের সপক্ষে এসব অভিযোগ খণ্ডন করতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। রোহিঙ্গা নিধনের বিরুদ্ধে আগেও তিনি কোনো ধরনের অবস্থান তো নেনইনি, বরং এ বর্বরোচিত ঘটনার দায় রোহিঙ্গাদের ওপরই চাপিয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষপাতিত্ব ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধাচরণের অভিযোগ করেছেন। তাঁর মতে, মিয়ানমার সাময়িক বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। এর আগে জাতিগত কাচিন ও কারেনদের ওপর নিধনযজ্ঞকেও তিনি কখনো সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ি মনে করেননি।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির এমন অবস্থানে অনেকে বিস্মিত হলেও অনেক বিশ্লেষক মোটেই বিস্মিত হননি। অনেকের প্রশ্ন যে এমনটা করে সু চি কি তাঁর অবশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্মান ও সুনাম খোয়াতে যাচ্ছেন? রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের প্রমাণযোগ্য দলিলাদির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি কী অর্জন করতে পারবেন? কীভাবে তিনি খণ্ডন করবেন গাম্বিয়ার ৪৪৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র, যেখানে অভিযোগের প্রামাণিক দলিলাদি রয়েছে? মোটাদাগে এর উত্তর হচ্ছে মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর সমর্থন ধরে রাখা। সু চির দ্য হেগে গিয়ে নিজেই মামলা মোকাবিলার ঘোষণা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। নেপিডো, ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ মধ্য মিয়ানমারের অন্যান্য শহরে অং সান সু চির এ উদ্যোগের সমর্থনে সামরিক বাহিনীর বড় বড় হোর্ডিং লাগানো হয়েছে। প্রতিদিন তাঁর এই পদক্ষেপের সমর্থনে শোভাযাত্রা ও মিছিল হচ্ছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই এ মামলার বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করেছেন সু চির সঙ্গে। কিন্তু এর বিস্তারিত জানা যায়নি।
সু চির এই সেনাপ্রীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সময়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা তিনি কখনো করেননি। ১৯৮৮ সালে যখন উ নু সামরিক জান্তাকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে ‘বৈধ প্রধানমন্ত্রী’ দাবি করে বিরোধীদের সমর্থন চেয়েছিলেন, সু চি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যেতে চাননি। এমনকি ওই সিদ্ধান্তে ভারতের সরাসরি সমর্থন ছিল। বিশ্লেষকেরা বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছে সু চির বাবা অং সানের নেতৃত্বে, যাঁকে সেনাবাহিনীর জেনারেল পদ দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার প্রাক্কালে। স্মরণযোগ্য যে অং সানের নেতৃত্বে ‘৩০ কমরেড’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতার দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এমনকি সু চি প্রায় এক যুগ অন্তরীণ থাকা অবস্থায়ও সামরিক বাহিনীর তেমন বিরোধিতা করেননি। ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। একই সঙ্গে একজন কট্টরপন্থী তেরাভেদা জাতীয়তাবাদী বুড্ডিস্ট হিসেবে সু চি নিজের অবস্থানকে জোরদার করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে সু চিকে এখন মিয়ানমারের দারুণ এক জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাজেই আগামী নির্বাচনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সু চি বড় দল নিয়ে হাজির হবেন দ্য হেগে। একই সঙ্গে শক্তি ও সমর্থন প্রকাশের জন্য দ্য হেগ শহরে মিয়ানমারের নাগরিকদের জড়ো করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকার সহাবস্থানে রয়েছে, তারাও সু চির এ পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘ওয়া’, দ্য মংলা এবং রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব সান স্টেট (আরসিএসএস)।
তবে শুধু সু চির পক্ষেই নয়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার সমর্থন করেছে আরাকান আর্মি (এএ), যারা রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আরও রয়েছে ‘তাং’ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও এদের রাজনৈতিক ফ্রন্টগুলো। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সু চির বিরোধিতা ও মামলার সমর্থনে রয়েছে আরও বেশ কিছু এথনিক গোষ্ঠী। কারেন গ্রুপের মানবাধিকার সংগঠনের মুখপাত্র চেরি জাহান বিশ্বের ৫০টি সমর্থক গোষ্ঠীকে সু চির বিরুদ্ধাচরণ করতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতে কারেন জনগোষ্ঠীসহ অন্যরা বিগত ৫০ বছর নিগৃহীত হয়েছে, যার দালিলিক প্রমাণ জাতিসংঘে রয়েছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে সু চির এ পদক্ষেপ দারুণ সাহস জুগিয়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযুক্তদের ও অন্যদের। তবে শুনানি কোন পথে যায়, সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিপ্রিয় মিয়ানমারের জনসংখ্যার একাংশ ও বিশ্ববাসী। সু চির এ জুয়া কতখানি কাজে দেবে, তা দেখার বিষয় হবে। অন্তত রোহিঙ্গা বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশদ আলোচিত হবে। তবে মামলার নিষ্পত্তিতে কয়েক বছর লাগতে পারে। আসতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ। কী হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা বাংলাদেশিরা মনে করি, সমস্যাটি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের নয়, সমস্যাটি মিয়ানমার ও দেশটির এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের মধ্যে। এর সমাধান মিয়ানমারের হাতেই রয়েছে। এ সমাধান পানি ঘোলা করে হবে, না আরও জটিল হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ এর শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করছি। সে কারণেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার পথও খোলা রাখতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
hhintlbd@yahoo.com