চেয়ারের সঙ্গে বোধ-আক্কেলের সম্পর্ক নিবিড়। অনেক হাবাগোবা লোককেও চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ামাত্র তার জ্ঞানবুদ্ধি খুলে যায়। সে তখন যাকে ইচ্ছা তাকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। আবার উল্টোটাও হয়। অনেক সময় ডক্টরেট ডিগ্রিধারী লোকও চেয়ারে বসার পর উল্টোপাল্টা বকা শুরু করে। রানা প্লাজা ধসে পড়লে সেটাকে তাঁর কাছে বিরোধী দলের ছেলেপেলের পিলার ধরে নাড়াচাড়ার ফল মনে হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আইকন নূর হোসেনকেও অনেকের কাছে ‘ইয়াবাখোর’ মনে হয়। অনেকের কাছে পেঁয়াজের কেজি দেড় শ টাকা ক্রস করার পরও বাজার ‘নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে’ বলে মনে হয়।
গুরুত্বপূর্ণ লোক কেন উল্টোপাল্টা কথা বলেন তা এক জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন। তাঁদের ‘মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে’। কেন করে? কেন?
কোটি টাকার এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথা হলো, ‘সব দোষ চেয়ারের। চেয়ারে বসলেই মাথাটা কেমন হয়ে যায়। জনসাধারণ-ফাধারণ ভুল হয়ে যায়। দেশফেশ ভেসে যায়। আসলে চেয়ার তো সাহেবি জিনিস। আর সাহেবরা একসময় দেশটাকে শাসন করত। শাসন মানে শোষণ। দেশটাকে তাই বাদুড়চোষা করে ফেলতে ইচ্ছে করে।’
দেশটাকে বাদুড়চোষা করা দেশবাসীর একরকম গা–সওয়া হয়ে গেছে। ড্রাকুলা রক্ত চুষে নিলে টের পাওয়া যায় না। ফলে সেই রক্তক্ষরণে কষ্ট কম হয়। কিন্তু দগদগে ক্ষতের ওপর যদি কেউ খোঁচা মারে, ঘায়ের ওপর যদি কেউ লবণ ঢেলে দেয়, তাহলে সে যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন। পাবলিক যখন সুনির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে রক্তাক্ত হয়ে কাতরাচ্ছে, ঠিক সেই সময় চেয়ারে বসা কিছু লোক নুন ছিটানোর কাজটা করছেন। সেই দগদগে ঘায়ের জ্বলুনিতে যে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়, সে বিষয়টি তাঁরা ভাবতে পারেন না।
সৌদি আরব থেকে যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক ফেরত আসছেন, তাঁদের কারও গায়ে মারের দাগ, মনে অপমানের চাবুকের ঘা ফুটে আছে। এ পর্যন্ত সৌদি থেকে কত নারী ধর্ষণ–নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরেছেন, তার কোনো লেখাজোখা নেই। বহু মা–বোন ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফিরে এখন স্বজনদের কাছেও ঠাঁই পাচ্ছেন না।
গত মাসে সৌদিতে এক শেখের বাড়িতে থাকা ‘কাজের মেয়ে’ নাজমা ফেসবুকে তাঁকে উদ্ধার করার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। ৫ মিনিট ১১ সেকেন্ডের এই ভিডিও বার্তায় সৌদি গৃহস্বামী এবং তাঁদের পরিবারের অন্যদের অকথ্য নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জীবনের আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। ভিডিও কলে কথা বলার কয়েক দিনের মধ্যেই নাজমা কফিনে শুয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁর মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ১১ জন লাশ হয়ে ফিরছেন।
নাজমাদের এই কান্না দেখে বা তাঁদের লাশ আসার এসব খবর পড়ে যখন দেশের মানুষের হৃদয় ঝাঁজরা হতে থাকে, সে মুহূর্তেও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদারকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘যাঁরা দেশে ফিরছেন, তাঁদের অধিকাংশই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন না। দেশে ফিরে তাঁরা গল্প বানাচ্ছেন।’ যদিও কথাটি তিনি গত বছর অবসরে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই কথার তিরের যন্ত্রণা এখনো জাতিকে বিদ্ধ করে চলেছে। যখন একেকজন নারীর লাশ দেশে ফেরে, তখন সবাই নমিতার কথাকেই সরকারের মনের কথা এবং স্থায়ী নীতি ভেবে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে থাকে। ম্যানপাওয়ারের ছদ্মবেশে ক্রীতদাস পাচারের ছবিটাই তখন সবার সামনে চলে আসে।
স্বৈরাচার এরশাদকে চেয়ার থেকে টেনে নামানোর জন্য নূর হোসেন বুক পেতে দিয়েছিলেন। বুলেট তাঁর বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। নূর হোসেনের সেই ছবি জাতির মনের মধ্যে এক দুর্দম প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে গেঁথে আছে। জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সেই আত্মত্যাগী নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ বলেছেন। তা–ও বলেছেন কোন দিনটাতে? ১০ নভেম্বর। যেদিন নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। যে তারিখটিতে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণাকে জাতি উপলব্ধি করে। ঠিক সেই দিনটাতে রাঙ্গা সাহেব জাতির মনের ক্ষতের ওপর নুন ডলে দিলেন। কোন জোরে তিনি এই নুন ডলা দিলেন? চোখ বুজে বলা যায়, চেয়ারের জোরে। চেয়ারটি জাপার মহাসচিবের চেয়ার। তাঁকে যাঁরা এই চেয়ারে বসিয়েছেন, তাঁরা আরও বড় চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর এই কথার সমালোচনা করে অবশ্য জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ‘বান্দর লাই দিলে মাথায় ওঠে’। তার মানে, চেয়ারে বসা যিনি বা যাঁরা ‘বান্দরকে লাই’ দিয়েছেন, তাঁরাও এই নুন ডলার কাজের ভাগীদার। পরে চাপের মুখে রাঙ্গা সাহেব তাঁর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও তা করেছেন ঔদ্ধত্যমূলক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে। ‘লাই দিলে’ যে ‘বান্দর’ মাথায় ওঠে এবং নূর হোসেনের মতো একটি জাতীয় প্রতিবাদী প্রতীককে নিয়ে ব্যঙ্গ করে তাঁকে মাথা থেকে নামানোর দায় যাঁরা মাথায় তুলেছেন তাঁদেরই।
পাবলিকের ক্ষতে সর্বশেষ খোঁচা মেরেছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে যখন মানুষকে ২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে, বহু লোক যখন পেঁয়াজ ছাড়া রান্না খেয়ে মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না, সেই মুহূর্তে তিনি বলেছেন, পেঁয়াজের বাজার ‘নিয়ন্ত্রণে’ চলে এসেছে (তাঁর এই বক্তব্যের দুই দিনের মাথায় পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় উঠে এসেছে)। তাও আবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে হঠাৎ বন্যার কারণে আমাদের পেঁয়াজের বাজার গরম হয়ে যায়। এ সময় ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিও বন্ধ করে দেয়। তবে আমরা অতি সত্বর তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি।...পেঁয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল, নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে।’
পেঁয়াজের আকালে পড়ে যখন ঝোল তরকারি মুখে তোলা যাচ্ছে না, বাগার ছাড়া ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে যখন কর্তাকে গিন্নির রান্নার হাতের প্রশংসা করতে হচ্ছে, উপকূলের লবণচাষিরা এক মণ লবণ দিয়েও যখন এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না, তখন শিল্পমন্ত্রী জাতির কাটা ঘায়ে এই নুনের ছিটা দিয়েছেন। অনেকে এটিকে কৌতুক হিসেবে নিয়েছেন। মানুষের অতি দুঃখে হাসার ব্যারাম আছে বলে তারা এই ‘কৌতুক’ শুনে হাসছে।
এই অবস্থার জন্য আসলে কেউ দোষী না। সব দোষ চেয়ারের। গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলো যখন ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ হয়ে ওঠে, তখন চেয়ারম্যানদের চেহারা এমনতরই হয়!
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin.ahmed@prothomalo.com