পরিবেশ

দেশে নদী ও নারী সবচেয়ে বিপন্ন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

হাজার হাজার বছর নদ-নদীকে কোনো মানুষের রক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। নদী ছিল আপন বেগে পাগলপারা। পর্বতের চূড়া থেকে নেমে অসংখ্য জনপদ, প্রান্তর ও বনভূমির ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশে গেছে। তাকে আক্রমণ বা বাধা দেওয়ার সাধ্যি ছিল না কারও। নদ-নদী ছিল অজাতশত্রু, আজ তারা অগণিত শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত।

নদ-নদী, শাখানদী, উপনদীর তীরেই গড়ে উঠেছে জনপদ, সেখানে বাস করেছে মানুষ ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়ে। নদীর পানি ব্যবহার করেছে মানুষ, তার পাড় দখলের দরকার হয়নি। নদীর পাড় নদীরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, লাখেরাজ সম্প‌ত্তি নয়, কারও পিতা–পিতামহের সম্পত্তি তো নয়ই। নদীর পাড় দখল করা যা, কারও বাড়ির উঠানের অংশবিশেষ দখল করাও তাই, অর্থাৎ অপরাধ। যেকোনো অপরাধই শাস্তিযোগ্য।

বিনা বাধায় নদীর পাড় দখলে বাংলাদেশ বিশ্বে অদ্বিতীয়। আবেদন-নিবেদন–প্রতিবাদে কিচ্ছু হচ্ছে না। এবার এসেছে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা। নদী দখলকারী ব্যক্তি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হবেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ব্যাংকঋণ পাবেন না। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ৩ ফেব্রুয়ারি এই নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত দেন।

এই রায়কে একটি ঐতিহাসিক রায় হিসেবে বিবেচনা করা হবে যদি তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত ও বাস্তবায়িত হয়। তুরাগ নদ রক্ষায় হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই নির্দেশনা দেন। সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন, জুরিসটিক পারসন ও জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়কে রক্ষা করার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। নদী দখলকারীদের নির্বাচনে অযোগ্য ও ব্যাংকঋণ না পাওয়া ছাড়াও আইন সংশোধন করে ‘কঠিন শাস্তি’র ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি জলাশয় দখলকারী ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা প্রকাশ, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ডিজিটাল ডেটাবেইস তৈরি এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানায় নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে বলা হয়েছে। আমরা দেশের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা এই রায়কে স্বাগত জানাই।

উচ্চ আদালতের এই রায়ে নদী রক্ষা কমিশন যাতে কার্যকর একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন করে অপরাধীদের ‘কঠিন সাজা ও জরিমানা’ নির্ধারণ করতে হবে। সে অনুযায়ী অপরাধ তদন্ত ও বিচারের আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে।

প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করত তাহলে নদী রক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজনই হতো না। হাজার বছর কোনো নদী রক্ষা কমিশন ছিল না। নদী তার মর্জিমতো আপন মনে প্রবাহিত হয়েছে। কথাটা নির্লজ্জের মতো বলতে হয়, আমাদের মতো ঢাল-তলোয়ারবিহীন পরিবেশকর্মীদের আন্দোলন ও দাবির ফলেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয় ২০১৩ সালে। গঠিত হলেও তারও ঢাল-তলোয়ারের অভাব। যার আঘাত করার ক্ষমতা নেই, তার কথা কেউ শুনবে না। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজও করছেন। আমাদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গেছেনও। কিন্তু বাংলার মাটিতে কার কথা কে শোনে? দখলকারীরা কথা শুনবে না সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সরকারেরও টনক নড়ানো সম্ভব হয়নি।

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এবং অন্যান্য পরিবেশবাদী সংগঠন নদীর দখল ও দূষণ বন্ধে বিচিত্র কর্মসূচি পালন করছে। আইন-আদালতেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এর আগে উচ্চ আদালতের এক রায়ে নদীর সীমানা রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সে জন্য সীমানা পিলার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অতি দ্রুত এবং অতি উঁচু দামে পিলার কেনার গরজ প্রবল থাকলেও নদীর সীমানা পিলার ভুল জায়গায়—নদীর বুকের মধ্যে বসানোতে—উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি।

নদীর অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষেরই প্রয়োজন হতো না যদি প্রশাসন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাই যথেষ্ট। তাঁদের সঙ্গে যদি স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা থাকেন, তাহলে কারও বাবারও সাধ্য নেই নদীর পাড়ের এক ইঞ্চি ভূমি কেউ দখল করে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সরকারি দলের নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় এই সাংঘাতিক দুষ্কর্মটি করে থাকেন। অনেক জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আন্তরিক, কিন্তু তাঁরা আমাদের কাছে বলেছেন অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তাঁরা অসহায়।

নদী রক্ষায় ২০ বছরে আমরা কত রকমের কত শত অনুষ্ঠান করেছি তার হিসাব নেই। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে হয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পানির মধ্যেও আমরা অনুষ্ঠান করেছি। নৌকামিছিল করেছি নদীতে। নদীর ভেতরে জনসভা করেছি নৌকায়। সভা, জনসভা, মানববন্ধন হয়েছে অগণিত। আবেদন–নিবেদন সংখ্যাহীন। কাজ হয়নি। সরকারের যদি দুটি পা থাকত, তাহলে সেই পায়ে গিয়ে পড়তাম এবং বলতাম: নদীকে বাঁচান। তার পাড় দখল থামান। সর্বশক্তি দিয়ে নদী দূষণ বন্ধ করুন। নদীর যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত এবং থাকত দুটি হাত, তাহলে সে নিজেই সরকারের ঘরে গিয়ে করজোড়ে বলত, ‘আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচলে আপনারা বাঁচবেন।’

আজ বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপন্ন নদী ও নারী। তাদের রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত আইন থাকলেও তার প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। আমরা আমাদের অনেক অমূল্য সম্পদ অবহেলায় হারিয়েছি। ফলে জাতি হিসেবে আমরা দরিদ্র হয়ে পড়ছি—বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুকে ডলারের পরিমাণ বাড়লেও।

একটি সুজলা–সুফলা, শস্যশ্যামলা সবুজ সুন্দর দেশ এক জিনিস, আর মধ্যম আয়ের অসুন্দর দেশ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। এই দুটির মধ্যে প্রথমটিকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়টিকে বেছে নিলে তা হবে দেশের জনগণের আত্মহত্যার শামিল। গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে গেলে একদিন না একদিন তা উপযুক্ত নেতৃত্বে পুনরুদ্ধার সম্ভব। নদ-নদীকে হত্যা করা হলে তাকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যেমন মৃত মানুষকে আর জীবিত করা যায় না। উচ্চ আদালতের এই রায় বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে নদ-নদী রক্ষায় আমাদের পুনর্যাত্রা শুরু হবে এই প্রত্যাশা করি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক