জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে টানাপোড়েন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথকে কণ্টকিত করতে পারে। কারণ আইন বলছে, সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বে কে থাকবেন, সেই বিষয়ে মতভিন্নতা দেখা দিলে ভোটাভুটি করে তার ফয়সালা দেবেন স্পিকার। আর বিরোধী দলের নেতাও বাছাই করার দায় স্পিকারের।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার মৃত্যু হওয়া বা অন্য কোনো কারণে সংসদের একটি মেয়াদে দুবার বিরোধী দলের নেতা নির্ধারণের উদাহরণ এর আগে সম্ভবত ছিল না। সেদিক থেকে স্পিকার ছয় মাসের ব্যবধানে দুজন বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, জি এম কাদের ও তাঁর সমর্থকেরা ভেবেচিন্তেই দলের চেয়ারম্যানের পদটি নিয়ে বিরোধী দলের নেতার আসনে রওশনকে দেখতে চাইতে পারেন।
কিন্তু প্রশ্নটি মোটেই জাতীয় পার্টির একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নয় এবং শুধু তারাই এটা সুরাহা করে ফেলার জায়গায় নেই। এরশাদ বেঁচে থাকতেও তা ছিল না। প্রশ্নটার সুরাহা এখন সরকারি দলের হাতে আরও বেশি বেগে ও ব্যাপকতায় চলে যেতে পারে। এরশাদবিহীন সংসদ গৃহপালিত কিংবা ‘গঠনমূলক বিরোধিতার’ আরেকটি নতুন উপাখ্যান প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে।
তবে এতে সন্দেহ সামান্য যে জাতীয় পার্টির টানাপোড়েন মোটেই ‘কাঁচা’ বা ঠুনকো বিষয় নয়। এটা ‘দেবর-ভাবির’ বিষয় নয়। দৃশ্যত, কাঁচা হাতে লেখা অনেক সময় যে অতটা কাঁচা হয় না, সেটা সম্ভবত অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
জেনারেল এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টির অনেকের কাছেই বর্তমান মন্ত্রিসভায় কারও ঠাঁই না পাওয়া একটি আঘাত। একটি বিস্ময়। দেশে নির্বাচন নিয়ে তর্কবিতর্কের মধ্যে মন্ত্রিসভা আকস্মিকভাবে জাতীয় পার্টি বা মহাজোটের শরিকেরা বাদ পড়ার ধাক্কা জাতীয় পার্টিকেই বেশি পীড়িত করেছে। কারণ, তারা মিত্রদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর অধিকাংশই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা অধীনতামূলক মিত্রতা বজায় রাখতে আগ্রহী।
এরশাদ শুরুতেই দর-কষাকষিতে নেমেছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতার জন্য ‘উপপ্রধানমন্ত্রী’ ও জাপার চিফ হুইপকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিতে আইন সংশোধনের দাবি তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, এবারের সংসদের সূচনাতেই তিনি স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়েন। প্রথম দিনে শপথ নিতেই পারেননি। এরপর যখন তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলো, তখনই নিশ্চিত জেনেছিলাম, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেন। কিন্তু সংসদে আর সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং, জেনারেল এরশাদের উত্তরাধিকারের বিষয়টি কীভাবে ফয়সালা হবে, সেটা নিয়ে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে একটা নাতিদীর্ঘ প্রস্তুতি ছিলই। সে কারণেই রওশন এরশাদকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে জাতীয় পার্টির ডাকা বৈঠকে জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করার বিষয়টি একটি যৌক্তিক পরিণতি। কিন্তু সেটা তো গেল যাঁরা জি এম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতার আসনে দেখতে চান, তাঁদের কথা। আর যাঁরা রওশন–অনুসারী, তাঁরা নিশ্চয় এই পদক্ষেপে সন্তুষ্ট হবেন না। তাই ‘কাঁচা হাতের লেখার’ বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বিস্ময় নেই। রওশন চান জি এম কাদের আপাতত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই থাকুন। রওশন তাঁকে ভারপ্রাপ্ত রেখেই বিরোধী দলের নেতার আসনটি চাইবেন। এরপর হয়তো নজর দেবেন দলের চেয়ারম্যান পদের দিকে।
এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টির বড় অংশ সর্বদাই ক্ষমতার অংশীদারত্বে বিশ্বাসী বলেই প্রমাণ রেখে চলছে। সংসদে উপনেতা হওয়ার দৌড়ে একাধিক সাংসদ রয়েছেন। তাঁরাও কাদেরকে হটাতে চান। জি এম কাদের গত সংসদে মন্ত্রিসভায় থাকার বিরোধী ছিলেন এবং বর্তমান সংসদে ‘প্রকৃত বিরোধী দল’ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে থাকেন। এখানেই তিনি সংসদীয় দলে সংখ্যালঘু এবং ক্ষমতাসীন সরকারের চোখে ‘খারিজি সম্প্রদায়ভুক্ত’ বনে যান।
প্রয়াত এরশাদ ছিলেন এর উল্টো দিকে। গত সংসদের মেয়াদে দলের কতিপয়ের মন্ত্রী থাকার বিরোধী ছিলেন ঠিকই, নির্বাচনে ফাইট দিতে প্রস্তুতিও নেন। কিন্তু তিনি কখনোই তাঁর মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত থাকার মওকা হাতছাড়া করতে চাননি।
বাংলাদেশ রাজনীতিকে যদি মুখ্যত পরিবারতন্ত্র ধরা হয়, যদি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাইদের কারও রাজনীতির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না দেওয়ার ইতিহাস আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে রওশন এরশাদ কিসে খুশি, সেটা কেউ সহজে কল্পনা করতে পারেন।
সার্বিক বিচারে জি এম কাদের যদিও দাদার খড়ম পায়েই উদিত হয়েছেন, কিন্তু তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার ছাপ রেখেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থার সংস্কারে আমরা তাঁকে দুই দশকের বেশি সময় ধরে সরব দেখেছি। রওশন রাজনীতির কী বুঝেছেন, সেটা ঠিক বুঝি না এখনো।
‘পতিত স্বৈরশাসক এরশাদের’ মলিন ভাবমূর্তির বিপরীতে কাদেরের ক্লিন ভাবমূর্তি আমরা লক্ষ করি। কিন্তু বাংলাদেশ রাজনীতি তো পরিচ্ছন্ন নয়। তাই এরশাদের মৃত্যুর পরে তিনি একেবারে বিনা বাধায়, বিনা পেরেশানিতে দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তা ভাবা সহজ নয়। সুতরাং, জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আমরা কিছু চমক যে সামনে দেখব, তা প্রায় হলফ করে বলায় ঝুঁকি কম।
রওশন এরশাদ ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে বিবৃতিটি তাঁরই সই করা। তিনি বিবৃতিতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান না হওয়া পর্যন্ত জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সাত সংসদ সদস্যসহ পার্টির দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য রয়েছেন।
সংসদে জাতীয় পার্টির চার সংরক্ষিতসহ ২৬ জন সাংসদ আছেন। এরশাদ যখন মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন বিরোধী দলের নেতা হলেন, তখন এটাও লক্ষণীয় যে তিনি কিন্তু স্ত্রীর চেয়ে যোগ্যতর বিবেচনায় প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন বিরোধী দলের উপনেতার আসনে জি এম কাদেরকে বেছে নেননি।
গত ৫ এপ্রিল এরশাদ রোগশয্যায় থাকতেই দেবর-ভাবির ভবিষ্যৎ টানাপোড়েন পরিষ্কার রূপ নেয়। ২২ মার্চ রাতে জি এম কাদেরকে জাপার কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ১২ দিনের মাথায় ৫ এপ্রিল পুনরায় তাঁকে স্বপদে বহাল করলেও মূল দ্বন্দ্বটা যে কী, সেটা আর চাপা ছিল না।
২৩ মার্চে বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকেও কাদেরকে অপসারণ করেছিলেন এরশাদ। তিনি ক্ষমতায় থাকতে সংবাদমাধ্যমে রসিকতা করে সিএমএলএ শব্দের একটি ব্যঙ্গার্থ উদ্ভাবন করা হয়েছিল। সেটা ছিল ‘ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট’।
রওশন এরশাদ এখন আসলে জি এম কাদের প্রশ্নে তাঁর প্রয়াত স্বামীর সবশেষ সিদ্ধান্তের ওপর একটা ‘সিএমএলএ’ ছাপ দিতে চাইছেন। এর কারণ খুব সোজা। ফার্স্ট লেডি টার্নড রাজনীতিবিদ রওশন এত দিনে বুঝে গেছেন, এটা থ্রি কি ফোর ইন ওয়ানের দেশ। সব ক্ষমতা মুঠোবন্দী না থাকলে ঠিক জোশ আসে না।
শুধু মন্ত্রীর মর্যাদায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে চলাই যথেষ্ট নয়, নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ফ্লোর ক্রসিং–সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদকে কার্যকর করতে এবং দলীয় সাংসদদের নিয়ন্ত্রণে দলের সভাপতির ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায়। আইনও সেটাই বলছে। সুতরাং রওশন এরশাদের দুটি পদই করতলে থাকতে হবে। সরকারের পক্ষে এমন ব্যক্তিকে সামলানোর বিকল্প আকর্ষণীয়।
যদি আমরা ধরে নিই যে এরশাদ তাঁর জীবনের শেষ ক্যু করার স্বাদ নিয়েছেন গত মার্চে, তাহলে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। কারণ, তিনি দল বা রংপুরের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে জি এম কাদেরের জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নেননি। তাঁকে সাইজ করা হলে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নেননি। তিনি কী করলেন? ২২ মার্চ রাতে জাপার কো–চেয়ারম্যানের পদ এবং পরদিন প্রাতে সংসদের উপনেতার পদ থেকে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অবলীলায় উৎখাত করেছিলেন।
এবং ২৩ মার্চের সূর্যাস্তের আগেই, স্ত্রী রওশন, যিনি স্বামীর শেষ জন্মদিনে নাকি কবিতা (স্বরচিত না হলে অবাক হব) আবৃত্তি করেছিলেন, তাঁকে এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার পদে অলংকৃত করান।
তাই বলি, শহীদ নূর হোসেনের প্রাণ উৎসর্গের ২৯তম বার্ষিকীতে এরশাদ সবার অলক্ষ্যে জীবনসায়াহ্নে এক নীরব রক্তপাতহীন সংসদীয় অভ্যুত্থানের সফল নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। সমগ্র জাতি তা হজম করেছে।
এখন রওশন এরশাদ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই সর্বশেষ সংসদীয় ক্যুর শতভাগ সুবিধাভোগী হতে চাইবেন। এরশাদের অন্তিম পারিবারিক ফরমানের শানে নুজুল হলো, জি এম কাদের দলের কো–চেয়ারম্যান কিংবা সংসদে দলের উপনেতা হওয়ার দাবিদার হতে পারেন না।
সুতরাং, অভিশপ্ত উত্তরাধিকারের রাজনীতি, যা ভারত– পাকিস্তানসহ এশীয় রাজধানীগুলোয় ধসে পড়ছে, সেটা ঢাকাই রাজনীতিতে, গ্রীষ্মের দাবদাহে নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে। অবশ্যই এ প্রক্রিয়া জনবিচ্ছিন্ন, অগণতান্ত্রিক এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই মানুষ এ ধারাকে বর্জ্যের মতো জলাঞ্জলি দেবে।
আপাতত প্রশ্ন হলো, দেবর-ভাবি দ্বন্দ্বে আমরা কার্যপ্রণালিবিধি স্পিকারকে প্রয়োগ করতে দেখব কি না। আইন বলছে, নেতৃত্বের প্রশ্ন দেখা দিলে, নেতৃত্বের দাবিদার কোনো সদস্য বিষয়টি জানিয়ে স্পিকারকে চিঠি দেবেন। স্পিকার তার সাত দিনের মধ্যে বিভক্তি ভোটের আয়োজন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নেতৃত্ব ঠিক হবে।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এ রকম একটি স্বচ্ছ ভোটের ব্যবস্থা চিন্তা করা মনে হয় স্বাভাবিক নয়। জি এম কাদের কিংবা জাপার ভবিষ্যৎ ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে।
সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের একটা সংকট ছিল, বিএনপির সাংসদেরা তা মিটিয়েছেন।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com