তিনি ইলেকশনে ‘খাড়াইছিলেন’। জিততে পারেননি। মার্কা ছিল উড়োজাহাজ। পোস্টারের উড়োজাহাজ ওড়ে না, চলে না। ছবির উড়োজাহাজ শতভাগ ‘প্রতিবন্ধী’ বলে তাঁতে গতি থাকে না।
সমস্যা হলো, তিনি শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির রাজনীতি করা নেতা। গতি না থাকাটা তাঁর জন্য দুর্গতি। সেই কারণে উড়োজাহাজ কিনতে না পারলেও তিনি ‘প্লেনের গতির’ দামি মোটরসাইকেল কিনেছেন। তা-হাকিয়ে বেড়ান। তাঁর গা-গতর বেশ শক্ত-পোক্ত। দামি জামা-প্যান্ট, জুতা, ঘড়ি, সানগ্লাস পরা তাঁর টকটকা চেহারা যেকোনো ওয়েব সিরিজের যেকোনো সাইড নায়কের চাইতে ত্যালত্যালা।
যাঁর কথা বলছি, তিনি হলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইদুল ইসলাম সরকার। ডাকনাম বাবু। বয়স ৩১ বছর।
মাইদুল সাহেবের কাছে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড আছে কি না, তা জানা যায়নি। তবে তাঁর কাছে ‘অসচ্ছল প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ড’ নামের একটি কার্ড আছে। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে সুবিধা আছে, সমস্যাও আছে। সুবিধাটা হলো ফট করে কেনাকাটা করা কিংবা বুথ থেকে নগদ টাকা তোলা যায়। আর ‘সমস্যাটা’ হলো, সেই সুবিধা নিতে হলে আগে উপার্জন করে ডেবিট কার্ডে টাকা জমা করতে হয়; ক্রেডিট কার্ড থেকে খরচ করলে তা পরে সুদসহ ফেরত দিতে হয়। ‘অসচ্ছল প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ড’-এ এই সমস্যা নাই। নির্দিষ্ট সময় পর সরকারের পক্ষ থেকে এই কার্ডধারীর অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যায়। টাকাটা শুধু কষ্ট করে তুলতে হয়।
অসচ্ছল পঙ্গু ও প্রতিবন্ধীদের এই ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু আলোচ্য ছাত্রলীগ নেতা সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েও এই কার্ড বানিয়েছেন। সেই কার্ডের সুবাদে তিনি ‘কষ্ট করে’ ভাতার টাকা তুলে ‘কষ্ট করে’ খাচ্ছেন। তিনি এই কার্ড দিয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় সরকারি চাকরির চেষ্টাও করেছেন।
ইতিহাসে অনার্স-মাস্টার্স করা মাইদুল বাবুর ‘লাইফ হিস্টোরি’ প্রথম আলোতে পড়ার পর থেকে তাঁকে কদমবুসি করার জন্য মন আকুলি-বিকুলি করছে। তাঁর ব্যাপারে যতই জানছি, ততই তাঁর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। ভাতের হাঁড়িতে বলক এলে ফ্যান যেভাবে দমকে দমকে ঢাকনা ঠেলে ওঠে, অবিকল সেইভাবে নাভিমূল থেকে কণ্ঠনালি বেয়ে বিপ্লবী ছাত্রনেতা ভাইটির জন্য ‘সংগ্রামী শুভেচ্ছা’ ঠেলে ঠেলে বেরোচ্ছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মাইদুল ইসলাম সরকারের নামে ইস্যু করা বইয়ের নম্বর ৭৯৬। সোনালী ব্যাংক আদিতমারী শাখায় তাঁর সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৫২০১৯০১০১৯৬০৯। এই নম্বর থেকে তিনি ১১ হাজার ২৫০ টাকা ইতিমধ্যে তুলে খেয়ে ফেলেছেন।
প্রতিবন্ধী কার্ড নেওয়ার বিষয়ে মাইদুল বলেছেন, ২০১৮ সালে প্রতিপক্ষের লোকজন তাঁকে খুব মেরেছিল। তাতে তাঁর হাতের একটা আঙুল ‘প্রতিবন্ধী’ হয়ে যায়। চিকিৎসক সেটা কাগজে-কলমে প্রত্যয়ন করে দিয়েছিল। সেই কাগজের জোরে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ ফরম পূরণ করে তিনি জমা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, প্রতিবন্ধী কোটায় একটা সরকারি চাকরি করবেন। কিন্তু চেষ্টা করে ‘প্রতিবন্ধী হয়েও’ তিনি চাকরি পাননি। এখন তিনি বলছেন, তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তাঁর আঙুলটাও সুস্থ।
মাইদুল রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করেন। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে ফেল করেছিলেন। তিনি পাস করুন আর ফেল করুন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এই বাজারে সাধারণত কত খরচ হয়, তা এখন মোটামুটি সবাই আন্দাজ করতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, মাইদুলকে ২০২০ সালে প্রতিবন্ধী বলে প্রত্যয়ন করেছিলেন আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নূর আরেফিন প্রধান। প্রতিবন্ধিতা-সংক্রান্ত সরকারি ফরমে স্বাক্ষর করেছিলেন আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রওশন আলী মণ্ডল।
এই দুই ভদ্রলোকের প্রগাঢ় মানবিক বোধ বিবেচনার কারণেই সুস্থ মাইদুল শেষ পর্যন্ত প্রতিবন্ধীর মর্যাদা পেয়েছেন। সেদিক থেকে ধরলে বলা যায়, এই ভাতার টাকার কিছু অংশ ওই দুই কর্মকর্তার প্রাপ্য। সারাজীবন মাইদুল তাঁদের একটা কমিশন দিয়ে গেলে জিনিসটা একটা ইনসাফের মধ্যে পড়ে। কারণ তাঁরা মাইদুলকে যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাতে মাইদুলকে হয়তো বন্ধুবান্ধব আদর করে সারা জীবন ‘প্রতিবন্ধী বাবু’ বলে ডেকে যাবেন।
প্রতিবন্ধী ভাতার এই কার্ড মাইদুলকে শুধু আর্থিক সুবিধা দেবে না, নানা ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। গণপরিবহনে উঠলে চালকের পেছনের যে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে, সেই আসনে তিনি টুক করে বসে পড়তে পারবেন। কেউ কিছু বললে তিনি কার্ড দেখাবেন। বিভিন্ন অ্যামিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে তিনি রাইডে উঠে পড়তে পারবেন। প্রতিবন্ধী কোটায় বিরাট ছাড় পাবেন। ব্যাংকের লাইনে, হাসপাতালে প্রতিবন্ধীদের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার সব তিনি পাবেন।
‘হ্যান্ডিক্যাপ’ মানে শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাইরের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের এখন ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ বলে না। সহমর্মিতার অনুভূতি থেকে তাদের ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড’ বা ‘শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা লোক’ বলে, কখনো কখনো বলে ‘ডিফারেন্টলি অ্যাবল্ড’ বা ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’।
এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার। সেটা হলো, মাইদুল এবং তাঁকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নূর আরেফিন প্রধান এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রওশন আলী মণ্ডল—এই তিনজন শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে ‘ডিফারেন্টলি অ্যাবল্ড’। যেসব দরিদ্র অসহায় পঙ্গু ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে, সেই মানুষের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নেওয়ার মানসিকতা যাঁরা বহন করছেন, তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী।
রাষ্ট্রকে, জনগণকে ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে গৌরব নেই, আছে শুধু চারিত্রিক দীনতা—এই কথা উপলব্ধির ক্ষমতা হারানো কর্মকর্তারা যে আসল প্রতিবন্ধী, তা বোঝার জন্য বইপত্র পড়ার দরকার নেই।
টেনশনের কথা, শারীরিকভাবে সুস্থ ও আর্থিকভাবে সচ্ছল হিসেবে পরিচিত এই মাইদুল, নূর আরেফিন প্রধান ও রওশন আলী মণ্ডলের মতো কত হাজার নৈতিকভাবে দীন-দরিদ্র এবং মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ আমাদের চারপাশে বিচরণ করছে, তা আমরা জানি না। সরকারের কোন স্তর পর্যন্ত এই প্রতিবন্ধীরা কোন মাত্রায় করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমিত হয়েছে, তা আমরা জানি না।
বাস্তবতা হলো, এই সচ্ছল মানসিক প্রতিবন্ধীদের কারণে প্রকৃত অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের একটা বড় অংশ এখনো সরকারি সুবিধা পাচ্ছে না। এরপরও স্বপ্ন সেই বঞ্চিত প্রতিবন্ধী ও অসহায় মানুষদের এসে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। সদরঘাটের ভিখিরির শূন্য বাটিতেও সোনারগাঁও হোটেলের স্বপ্ন ক্ষীরের মতো জমে থাকে। অথচ তার কপালে উপুড় করা বাটির প্রতিবন্ধী অন্ধকার।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com