দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতেই হবে

.

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এই বিশ্বখ্যাত বাঙালি অর্থনীতিবিদ বরাবরই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব, তাঁর গবেষণাগ্রন্থ এবং প্রবন্ধগুলোতে উন্নয়ন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রতিফলিত। এবারের সফরের সময় পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত বক্তব্যগুলোও তাই মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছি। ১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। আমার কলামে সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য এবং অব্যক্ত মতামত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যার মধ্যে ভালোবাসার ছোঁয়া থাকলেও অতিশয়োক্তি নেই। কিন্তু একজন সফরকারী মেহমান কঠোর সত্য উচ্চারণ করলে তা মেজবানের জন্য বিব্রতকর হবে বলে তিনি বেশ কিছু কথা নরম সুরে বলেছেন। ওই বক্তব্যগুলোর আসল তাৎপর্য যদি অনুধাবন করতে ভুল করি, তাহলে তাঁর পথনির্দেশনামূলক মন্তব্যের আলোকে উন্নয়নকৌশল গ্রহণের কাজটা করতে আমরা ব্যর্থ হব।
বাংলাদেশের এবারের (মানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন কৌশিক বসু পুনরুল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। অধ্যাপক বসু বাংলাদেশের ১২ বছর ধরে এই ধারাবাহিক ৬ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনকে বিশ্বের গুটিকয় সফল উন্নয়নশীল দেশের বিরল সাফল্যের নজির বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। জাতি হিসেবে আমাদের এ জন্য গর্ববোধ করা উচিত। তাঁর ইতিবাচক ও প্রশংসামূলক মন্তব্য আমাদের উজ্জীবিত করবে। তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে অবকাঠামোর ঘাটতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা গেলে এবং ‘আমলাতন্ত্র কমালে’ বা ‘আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে’ বাংলাদেশের জিডিপি, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এখানেই তিনি কিছুটা আড়াল রেখে একটু ঘুরিয়ে যে কঠিন কথাটা বলতে চেয়েছেন, পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে এই কলামে তা সরাসরি বলছি আমি। এর মাধ্যমে তিনি দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমানোর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ইস্যুতে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক নিজেদের ঋণপ্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছে, এটা সবার জানা। বিষয়টি এখনো কানাডার একটি আদালতের মামলায় বিচারাধীন। তাই বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করাই স্বাভাবিক। ওই দুর্নীতির অভিযোগের সত্যাসত্য সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি। প্রসঙ্গটি পাশ কাটানোর জন্য তিনি বললেন, ওটা ছিল খারাপ ইতিহাস। কিন্তু ওই খারাপ ইতিহাস থেকে একটা খুব ভালো ফল বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সাহস করে যে নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার অকৃপণ প্রশংসা করেছেন। এ ধরনের সাহসী অবস্থান গ্রহণ সাত–আট বছর আগে বাংলাদেশের জন্য অচিন্তনীয় ছিল, কিন্তু যখন বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, তখন এই সাহস মানায় বৈকি! কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করে কী সুন্দর জবাব!
কিন্তু তাঁর মতো একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদের তো বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে দুর্নীতির ইস্যু কোনোমতেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্যই বেশ কয়েকবার তাঁর সাক্ষাৎকারে ঘুরেফিরে দুর্নীতির প্রসঙ্গটি এসেছে। কারণ, বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো উন্নয়ন–চিন্তাবিদ যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন-অনুন্নয়ন নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেন তাহলে তাঁকে বলতেই হবে যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ‘টেক অফ’ (উড্ডয়নের সূচনা বা উড্ডয়ন সম্ভাবনা) সারা বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে টেকসই করতে হলে বা স্থায়িত্ব দিতে হলে উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারণ, প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ হারিয়ে যাচ্ছে এই দুর্বৃত্তদের বেলাগাম অপকর্মের শিকার হয়ে এবং ক্ষমতাসীনদের মার্জিন আহরণের অপরাজনীতির কারণে। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁকে কেনা যায় না। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু দুর্নীতি দমনে তাঁর সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে এই একটি ব্যাপারে তাঁর সরকারের সঙ্গে তাঁর পূর্বসূরি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তেমন গুণগত পার্থক্য তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী এবং সর্বোপরি ‘হাওয়া ভবনের’ যুবরাজ ও তাঁর ইয়ার-দোস্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলোর অধিকাংশই শুরু করেছে ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের প্রবল ক্ষমতাধর দুর্নীতি দমন কমিশন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মীও ওই সময় মামলার আসামি হয়েছিলেন, যদিও আওয়ামী লীগ ২০০১-০৬ মেয়াদে বিরোধী দলে থাকায় বোধগম্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অনেক কম ছিল। বেশ কিছু রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী-শিল্পপতিও দুর্নীতির জালে ধরা খেয়েছিলেন জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভূতপূর্ব প্রতিরোধযুদ্ধে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে আইনগত ও পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে ওই সময়ে রুজু করা মামলাগুলোর কার্যক্রম পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে আইনগত ত্রুটি নতুন আইনের মাধ্যমে সংশোধন করে মামলাগুলো আবার শুরু করতে হয়েছে।
আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অধ্যাদেশকে তামাদি হয়ে বাতিল হতে দিয়ে এর পরিবর্তে যে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস হয়েছে, তাতে দুদককে অনেকটা ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন খোদ দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান। উপরন্তু অভিযোগ উঠেছে যে ক্ষমতাসীন জোটের নেতা-কর্মীদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়ে দুদক শুধু অতীতের সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি নিয়েই তদন্ত এবং মামলা চালানোয় বেশি আগ্রহ ও পারদর্শিতা প্রদর্শন করছে।
বিরোধী মহলের এহেন যে অভিযোগ অহরহ শোনা যাচ্ছে সে ব্যাপারে দুদককে সাবধানতার সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেই হবে। কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমতাসীন মহলের দুর্নীতির অভিযোগগুলো বেশি গুরুত্ব পাওয়া স্বাভাবিক, এগুলো অপেক্ষাকৃত তরতাজা বলে। স্বীকার করে নিতে হবে, গত ছয় বছরে দুর্নীতি যে মোটেও কমেনি, সেটা সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের কল্যাণে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ওগুলো সবিস্তারে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুদক তো অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই তদন্ত এবং মামলা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে না। অতএব, দুদক যে দুর্নীতি উদ্ঘাটনে একপেশে অবস্থান নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে, তাতে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও লুটপাটকে ছাইচাপা দেওয়া যাচ্ছে না। বরং এ ধরনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অবশ্য এটাও বলতে হবে, বিএনপি-জামায়াত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যেভাবে দুর্নীতি মামলাগুলোর বিচার–প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করছেন, তাও সৎসাহসের পরিচায়ক নয়।
অন্যদিকে, এটা এখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর ও আশির দশকের বহুল উচ্চারিত ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ থেকে ইতিমধ্যে মুক্ত হয়ে ক্রমেই প্রবৃদ্ধির ‘ভার্চুয়াস সার্কেলে’ উত্তীর্ণ হয়ে উন্নয়নের পথে ধাবিত হয়েছে। খয়রাতনির্ভরতার গ্লানিকর অবস্থান পেছনে ফেলে উৎপাদন ও বাণিজ্যনির্ভর গতিশীল অর্থনীতি হিসেবে দেশের এই আশাপ্রদ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার বিপদটাও কৌশিক বসুর মূল্যায়নে উঠে এসেছে। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য তাণ্ডবের মধ্যেই এই বিপদ নিহিত। তাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও রুখে দাঁড়াতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর আশাবাদী উচ্চারণগুলো প্রমাণ করছে যে উন্নয়নের স্বর্ণ-সম্ভাবনা এখন বাংলাদেশকে আবাহন জানাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির এই ক্রমবর্ধমান জোয়ার অব্যাহত রাখতে পারলে বাংলাদেশ যে অতি দ্রুত মধ্যম আয়ের একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে, উন্নয়ন-চিন্তাবিদদের মধ্যে এই বিষয়ে মোটামুটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা চলে।
কৌশিক বসুর প্রেসক্রিপশন, গণতন্ত্রই সবচেয়ে কার্যকর সরকারব্যবস্থা। যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক, গণতন্ত্রকেই এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তাঁর যে অব্যক্ত কথাটা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তা হলো, এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যাত্রাপথে এক নম্বর বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের অব্যাহত ধারা। আমি বুঝি না প্রধানমন্ত্রী কেন এই দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরাদের বিরুদ্ধে এখনো সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না। তাঁর এবং তাঁর দলের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এটাই একমাত্র পথ। তাঁর সরকারের সাফল্যগুলোকে বরবাদ করার জন্য দুর্নীতিই হবে প্রতিপক্ষের হাতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া ও তাঁর ছেলের মারাত্মক চালের ভুলে শেখ হাসিনা ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশশাসন চালিয়ে যাওয়ার যে স্বর্ণসুযোগ পেয়ে গেছেন, সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দেশের অর্থনীতিকে সত্যিকার অর্থে একটা শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারলে জনগণ বিএনপি-জামায়াতের পাকিস্তান-পসন্দ নেতিবাচক রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা হাসিলের যে অপকৌশল বিএনপির রাজনীতির মূল ফোকাস রয়ে গেছে, আগামী তিন বছরে তাকে অকার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি উভয়ের বিরুদ্ধেই সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।