২৩ জানুয়ারি ২০২০ বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) তাদের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৯ প্রকাশ করেছে। সূচক অনুযায়ী ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশ ২৬ স্কোর পেয়েছে, যা ২০১৮–এর সমান। ১৮০টি দেশের মধ্যে শীর্ষ স্কোর, অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা সবচেয়ে কম, এমন দেশ থেকে গণনা করে বাংলাদেশ ১৪৬তম স্থান পেয়েছে, যা ২০১৮–এর তুলনায় ৩ ধাপ ওপরে। সর্বনিম্ন স্কোর, অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি, এমন দেশ থেকে গণনা করে এবার বাংলাদেশ ১৪তম, যা ২০১৮–এর তুলনায় ১ ধাপ ওপরে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন।
এ সূচকের মূল নির্ণায়ক অর্থাৎ স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান, বিশেষ করে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি আশা করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যেসব কারণে তা হয়নি, তার মধ্যে রয়েছে, প্রথমত, শুদ্ধি অভিযানের ফলে সৃষ্ট আশাবাদের চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি, এবং দ্বিতীয়ত, রাজনীতির সঙ্গে অর্থ ও দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্কের ব্যাপক বিকাশের ফলে একদিকে রাজনীতির সঙ্গে জনস্বার্থের বিচ্ছিন্নতা এবং অন্যদিকে জবাবদিহি কাঠামোর ক্রমবর্ধমান অকার্যকারিতা। এই সূচকের বিশ্লেষণে দ্বিতীয় উপাদানটিকে বৈশ্বিক প্রবণতা হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক শুদ্ধাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি যেমন একদিকে উচ্চতর স্কোর নিশ্চিত করে, তেমনি অন্যদিকে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার ও জবাবদিহির ঘাটতি এই সূচকে নিম্ন স্কোরের অন্যতম কারণ।
দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান, ৬৮ স্কোর পেয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২৫তম, এরপর ভারত ৪১ স্কোর পেয়ে ৮০তম, শ্রীলঙ্কা ৩৮ পেয়ে ৯৩তম, নেপাল ৩৪ পেয়ে ১১৩তম, পাকিস্তান ৩২ পেয়ে ১২০তম, মালদ্বীপ ২৯ পেয়ে ১৩০তম এবং আফগানিস্তান ১৬ পেয়ে ১৭৩তম। বৈশ্বিক তালিকায় সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে সোমালিয়া, ৯ পয়েন্ট। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশীয় সব দেশেরই স্কোর সূচকের গড় ৪৩–এর নিচে, অর্থাৎ এ অঞ্চলে দুর্নীতির ব্যাপকতা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। কোনো দেশই শতভাগ স্কোর পায়নি। ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৩১টি অর্থাৎ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশ ৫০–এর কম স্কোর পেয়েছে। ১০৮টি দেশ (৬০%) সূচকের গড় স্কোর ৪৩–এর চেয়ে কম পেয়েছে। ৬৮টি দেশের (৩৮%) স্কোর ২০১৮–এর তুলনায় কমেছে, ৬০টিতে বেড়েছে, আর ৫২টি দেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০০১ থকে ২০০৫ পর্যন্ত পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ সর্বনিম্ন স্থানে ছিল। এবারসহ মোট ১৩ বার সোমালিয়া এ সূচকে সর্বনিম্ন স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে ২০০৬ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সূচকের স্কোর ও অবস্থান বিবেচনায় কিছুটা স্বস্তিদায়ক অগ্রগতি অর্জন করলেও আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।
দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা যে উদ্বেগজনক, তার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ঘটেছে এই জরিপের তথ্য সংগ্রহের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহার প্রকাশ উপলক্ষে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পর তিনি মন্ত্রীদের প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাবধানবাণী পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। নির্বাচনের পর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন: এক, যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের আত্মশুদ্ধির চর্চা করতে হবে; দুই, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতিকে উচ্ছেদ করা হবে; তিন, তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা এবং চার, দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের সহায়তার গুরুত্ব দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বর ২০১৯–এ ‘শুদ্ধি অভিযান’ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শূন্য সহনশীলতার পুনরাবৃত্তি করেন এবং একই সঙ্গে নিজের দলের নেতা-কর্মীসহ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না মর্মে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন।
তবে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা যতটা সময়োপযোগী ও যৌক্তিক, এর বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন ও জটিল, বিশেষ করে এমন পরিবেশে যেখানে রাজনৈতিক এবং শাসনব্যবস্থার সব ক্ষেত্র ও পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র প্রভাব প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে; যেখানে যাদের ওপর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, তাদেরই একাংশের যোগসাজশেই দুর্নীতি হয় এবং তার সুরক্ষা ঘটে। জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে ব্যাপক দলীয়করণ ও অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত অভিযানের সুফল কতটুকু হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ অযৌক্তিক নয়।
অন্যদিকে দুর্নীতি যে বাস্তবেই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং দুর্নীতি করে বিচারহীনতা উপভোগ করা যায় না, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনে ঘাটতির ফলে চুনোপুঁটি থেকে রুই-কাতলার দুর্নীতির মহোৎসবের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বালিশ-কেটলি-পর্দা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে ক্যাসিনো–বাণিজ্যের মতো উৎকট সাগরচুরি ও অবৈধতার তথ্য দেশবাসীকে হতবাক করেছে। আর পর্যবেক্ষকদের কাছে এসব হিমশৈলীর চূড়ামাত্র। ব্যাপক আলোচিত প্রায় প্রতিটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে ছিল ব্যবসা ও রাজনৈতিক পরিচয়ে ক্ষমতাবান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজশ।
সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমাগতভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এজেন্ট ও সুবিধাভোগীদের করায়ত্তের মুখোমুখি, যার প্রকট দৃষ্টান্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত। জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির কারণে জর্জরিত এ খাতের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের মূল নির্ণায়ক ছিল জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির সংস্কৃতির অব্যাহত সুরক্ষা প্রদান, যার বোঝা বইতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। দুর্নীতি আজ প্রায় সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাদ যায়নি দুর্নীতি দমন কমিশনও, যার উচ্চপর্যায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্ত জনগণের হতাশাকে ঘনীভূত করেছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার সহায়ক ব্যাপক রূপান্তর ব্যতিরেকে দুর্নীতির কার্যকর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। রাজনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বৃত্তায়ন ও অবৈধ অর্থের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর প্রয়োগের স্বার্থে আইন প্রয়োগসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সরকারি সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবশালী মহলের প্রভাবমুক্ত করে জনস্বার্থের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগসহ সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি উৎখাত করতে হবে।
ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার অর্থ নিজের সম্পদের বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে ক্ষমতাবান ‘গডফাদার’দের বিচারহীনতা বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি যে–ই করুক, অবস্থান বা পরিচয়নির্বিশেষে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাতে গগনচুম্বী ঋণখেলাপির কেন্দ্রীয় নায়কদের রাষ্ট্রকাঠামোতে ক্রমবর্ধমান প্রভাবশালী ভূমিকার মূলোৎপাটন করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের যথাযথ প্রয়োগ করে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান—এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কারও প্রতি ভয় বা করুণা না করে দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের কার্যকরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান নয়, এই ধারণা সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের ভূমিকার স্বীকৃতি কার্যকর করতে হবে। গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনসহ নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অবাধ অংশগ্রহণের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতের দায়িত্ব সরকারের। বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সব আইন, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত সব ধারার সংশোধন করে ঢেলে সাজানো অপরিহার্য। সমালোচক সরকারের শত্রু নয়, বরং সরকারের সহায়ক শক্তি। যেসব দেশ বাক্স্বাধীনতা ও তথ্য বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে, তারাই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ–এর নির্বাহী পরিচালক