প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ বলেছেন। দুর্নীতি হলো উইপোকা। এই উইপোকা উন্নয়নকে ধ্বংস করে। উইপোকা যদি ধরে, সব খেয়ে তুষে পরিণত করে। একটা ঘরের খুঁটি বাইরে থেকে হয়তো মজবুত দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ধরেছে উইপোকা। খুঁটির বাইরের রংটাই হয়তো আছে, ভেতরটা একেবারে ফাঁপা। একদিন সামান্য বাতাসে পুরো ঘর ধরমর করে পড়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন, প্রগতি, শান্তি ও অগ্রগতির প্রধান চার শত্রুকে চিহ্নিত করেছেন। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও দুর্নীতি। তিনি বলেছেন, এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।
এই চার শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইটা কেবল সরকার করবে, সরকারপ্রধান করবেন, তা নয়; সর্বস্তরের মানুষকেই এই লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে, সবাইকে এই লড়াইয়ের সমর্থনে এগিয়ে আসতে হবে, নিজেদের বহু বছরের আচরিত বদভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ধরা যাক, মাদক। মাদক এই দেশে এক বড় সমস্যা। বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এক পরিসংখ্যান বলছে, বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো মাদকের পেছনে ব্যয় হয়। এই টাকার বেশির ভাগটাই আসলে বিদেশে চলে যায়। কারণ, ফেনসিডিল কিংবা ইয়াবা এ দেশে উৎপাদিত হয় না। মাদকের কেনাবেচা, চোরাচালান-এসবের সঙ্গে জড়িত থাকে বড় বড় অপরাধী চক্র। ব্যবহৃত হয় অস্ত্র, তৈরি হয় গ্যাং। আবার যে ব্যক্তি মাদকাসক্ত, তিনিও তাঁর মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়েন সহজেই। এখন এই মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইটা সরকার একা করতে পারবে না। সরকার যা পারে তা হলো বিদেশ থেকে মাদক আসার পথটা রুদ্ধ করে দিতে, বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীকে দমন করতে, তাঁদের চক্রটাকে নির্মূল করতে। কিন্তু প্রত্যেক নাগরিককে এই লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর সেই লড়াই হলো নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। আমি নিজে মাদক নেব না। আমার বন্ধুকে মাদক নিতে দেব না।
বায়ুসাগরে বসবাস করার মতো আমরা দুর্নীতির সাগরে বসবাস করি, কিন্তু অনেক সময় টেরও পাই না যে আমরা নিজেরাই কেবল দুর্নীতির শিকার নই, আমরা দুর্নীতিতে অভ্যস্তও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, দুর্নীতি তিন ধরনের-বড় দুর্নীতি, ছোট দুর্নীতি আর নীতিগত দুর্নীতি। বড় বড় রাষ্ট্রীয় কাজে হয় বড় দুর্নীতি। আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ছোটখাটো দুর্নীতিতে। আবার নিজেদের সুবিধার জন্য যদি কেউ সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নীতির অদলবদল করেন, তখন সেটা হয় নীতিগত দুর্নীতি।
ধরা যাক, শিক্ষক স্কুলে পড়ান না ভালো করে। কিন্তু যখন তিনি প্রাইভেট টিউশনি করেন, তখন ভালো করে পড়ান। এটা হলো ছোট দুর্নীতির উদাহরণ। আবার সেই শিক্ষক যদি তাঁর প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দিয়ে সাহায্য করেন বা বেশি নম্বর দেন, তখন ছোট দুর্নীতির একটা দগদগে উদাহরণ হয়ে ওঠে সেটা।
দুর্নীতি বড় হোক, ছোট হোক, উইপোকার মতোই তা দেশের উন্নতি ও প্রগতিকে ধ্বংস করে। কিন্তু বড় দুর্নীতির ক্ষতির পরিমাণ হয় অনেক বড়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ঋণখেলাপের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণখেলাপ আমাদের অর্থনীতিকে উইপোকার মতোই ঝাঁঝরা বানিয়ে ছাড়ছে। এই টাকায় যদি সত্যিকারের বিনিয়োগ হতো, দেশে উৎপাদন বাড়ত, প্রবৃদ্ধি বাড়ত, কর্মসংস্থান হতো। আমাদের আশঙ্কা, ঋণখেলাপের টাকা ব্যয় হয় বিলাসব্যসনে। বেশির ভাগ টাকা চলে যায় বিদেশে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে উইপোকার দংশনে ক্ষতবিক্ষত করছে।
এরপর আসে নির্মাণে, উন্নয়নকাজে দুর্নীতি। আমরা দেখেছি, আমাদের নির্মাণকাজে ইস্পাতের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের কঞ্চি। পাকা রাস্তা হবে, নির্মাণের পরে দেখা গেছে, মাটির ওপরে পিচ ঢালাই করা হয়েছে, নিচে কোনো ভিত্তি নেই, ইট-সিমেন্ট-খোয়ার যেসব স্তর থাকার কথা ছিল, তা নেই। রূপপুর প্রকল্পে বালিশ কেনা আর বালিশ ওপরে তোলার যে বিল করা হয়েছে, তা সর্বপ্রকার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশে প্রতি মাইল রাস্তার নির্মাণ খরচ সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দুর্নীতির সঙ্গে মিলেছে অদক্ষতা আর অযোগ্যতা। ফ্লাইওভার নির্মাণের পর আমরা টের পেয়েছি, এটা আসলে আমেরিকান নকশার নকল, এটায় উঠতে হবে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা চলি রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে। তখন আবার কেঁচে গণ্ডূষ করো।
নির্মাণকাজে বা প্রকল্প সম্পন্ন করতে গিয়ে যে দুর্নীতি করা হয়, তার ক্ষতি ভয়াবহ। আমাদের রাস্তাঘাট হওয়ার কথা ছিল মসৃণ, টেকসই, কিন্তু দুর্নীতির কারণে এক বর্ষার পানিতেই সব নষ্ট হয়ে যায়। জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়।
আছে কর আর শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা। বস্তুত শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি-রপ্তানির নামই চোরাচালান। কিংবা আমদানি বা রপ্তানি নিষিদ্ধ দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে চোরাচালান। যাঁরা খাদ্যে ভেজাল মেশান, ওষুধে ভেজাল মেশান, শ্যাম্পু-সাবানে ভেজাল মেশান, তাঁরা কেবল দুর্নীতি করেন না, তাঁরা মানুষ খুন করেন এবং এই খুন গণহত্যার শামিল। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ প্রকাশিত হয়েছে এক লজ্জার খবর, বাংলাদেশ-ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা হলুদে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এটা দেওয়া হয়েছিল হলুদের রংকে আরও হলুদ দেখানোর জন্য।
আমাদের সেবা খাতগুলোতে দুর্নীতির বিষয়ে মানুষের ধারণা সম্পর্কে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে টিআইবি। তাতে আমরা দেখতে পাই, আমাদের থানা-পুলিশ, আমাদের হাসপাতাল, আমাদের ভূমি অফিস ইত্যাদি নানা খাতে দুর্নীতির শিকার হয়ে থাকে সাধারণ নাগরিকেরা। দুর্নীতি কীভাবে আমাদের উন্নয়নের প্রয়াসকে উইপোকার মতো ধ্বংস করছে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আমার একটা ভাঙাচোরা বাস আছে। এটা আসলে রাস্তায় চলার উপযুক্ত নয়। এখন আমি ঘুষ দিয়ে একটা ফিটনেস সার্টিফিকেট আনলাম। এরপর একজন চালক লাগবে। চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। তিনি ঘুষ দিয়ে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স আনালেন। এখন এই গাড়ি রাস্তায় নেমে যাত্রীসাধারণের জীবন দুর্বিষহ করতে পারে, দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
এক ঘণ্টার বৃষ্টির পানিতে ঢাকা বা চট্টগ্রাম সয়লাব হয়, এর পেছনে আছে দক্ষতার অভাব, পরিকল্পনার ত্রুটি, দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা এবং আমাদের সাধারণ নাগরিকদের আচরণগত সমস্যা।
এখন বড় বড় দুর্নীতি থেকে শুরু করে ছোটখাটো, কিন্তু সর্বস্তরের দুর্নীতির মূলোৎপাটন যদি করতে হয়, ব্যাপারটা শুরু করতে হবে ওপর থেকে। বড় বড় দুর্নীতি বন্ধ হলে উন্নয়নকাজ এগিয়ে যাবে, তার সুফল পাবে মানুষ। একটা হাসপাতাল ভবন পরিকল্পনায় যদি সুনীতি থাকে, নির্মাণে যদি দুর্নীতি না হয়, ডাক্তার-পরিচালক-কর্মচারী নিয়োগে যদি দুর্নীতি না হয়, পর্যাপ্ত ওষুধ ও সরঞ্জাম যদি দুর্নীতি ছাড়া সেখানে সরবরাহ করা হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি ফাঁকি না দেন, তাহলে সেই হাসপাতালে মানুষ সুচিকিৎসা পেয়ে ধন্য ধন্য করবে। কিন্তু এই শিকলের একটা অংশ যদি ছিন্ন হয়, তাহলেই পুরো প্রয়াসটা হয়ে পড়বে উইয়ে খাওয়া একটা অর্থহীন প্রকল্প। একজন পুলিশ সদস্য যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকেন, তিনি অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। অন্যথায় অপরাধ বাড়বে, সমাজজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই শুরু হোক। এটা আমাদের উন্নয়নকে গতিশীল করবে। প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। নাগরিকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করবে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে, মাথাপিছু আয় বাড়লে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হলে এই দেশে সুশাসনও আসবে। পুঁজি নিজের স্বার্থে নিজেকে পাহারা দিতে সুশাসন আনবে। আমাদের প্রবাসী বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা দেশে ফিরে এসে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। দুর্নীতির বিষচক্র ভেঙে ফেলতে পারলে সেটা আবার উন্নয়নের মধুচক্রে উন্নীত হবে।
আপনারা বলতে পারেন, আমি আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে অর্থবহ ও টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া হলে সত্যি সত্যি বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে। কিন্তু উইপোকা দমনের নিয়ম হলো, ঘরে যতটা উইপোকা আছে, তার সবটাই ধ্বংস করতে হয়। একটা উইপোকাওয়ালা বই বা কাপড় যদি থেকে যায়, আবারও পুরো ঘর আক্রান্ত হবে। লড়াইটা কঠিন, কিন্তু তা চললে জনগণকে পাশে পাওয়া যাবে, এটাই প্রধান ভরসা।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক