নির্বিচার পাহাড় ও টিলা কেটে সাদা মাটি উত্তোলনের সাক্ষী আজও বহন করে চলেছে দুর্গাপুরের সাদা মাটি এলাকাগুলো
নির্বিচার পাহাড় ও টিলা কেটে সাদা মাটি উত্তোলনের সাক্ষী আজও বহন করে চলেছে দুর্গাপুরের সাদা মাটি এলাকাগুলো

মতামত

দুর্গাপুর ও ধোবাউড়ায় প্রতিবেশ ও জনজীবন ধ্বংসের মুখে

আমরা ১০ সদস্যের নাগরিক প্রতিনিধিদল কয়েক দিন আগে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে ও ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়ায় কয়েকটি সাদা মাটি আহরণস্থল পরিদর্শন করি এবং স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশে এর প্রভাব অবলোকন করি। দুটি উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে স্থানীয় হাজং, মান্দি ও বাঙালি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। দুর্গাপুর প্রেসক্লাবে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। এ থেকে যে প্রতীতি আমাদের জন্ম হয়েছে, বর্তমান লেখায় তা বলার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিট পিটিশনের (নং ১১৩৭৩/২০১৫) পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার মেজপাড়া, আরাপাড়া ও পাঁচকানাইহা মৌজা থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ছাড়া এবং নির্বিচার পাহাড় ও টিলা কেটে সাদা মাটি আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এমন কাজকে জনস্বার্থের পরিপন্থী বলে আখ্যা দেন। এর ফলে দুর্গাপুরের উল্লেখিত মৌজাসমূহে সাদা মাটি আহরণ প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। অথচ কয়েক গজ দূরেই ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় একই কায়দায় অপরিকল্পিতভাবে টিলা কেটে এখন সাদা মাটি উত্তোলন অব্যাহত আছে। একই পাহাড়, একই প্রকৃতি, একই জীববৈচিত্র্য। এক জায়গায় ভারসাম্য নষ্ট হলে অন্য জায়গায়ও ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। শুধু ভিন্ন জেলায় পড়েছে বলে তো প্রতিবেশগত প্রভাব কম হবে না।

কী পরিমাণ সাদা মাটি উত্তোলন করা হয়েছে, তা তদারকির কোনো কৌশল বিদ্যমান না থাকায় কোনো কোম্পানি প্রশাসনিক অনুমতি পেলে তার পক্ষে ইচ্ছামাফিক খনন ও উত্তোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিন পর এই অঞ্চলে আদৌ কোনো টিলা ও টিলার বাস্তুসংস্থান অবশিষ্ট থাকবে কি না সন্দেহ। এখানকার খননকারী কোম্পানি ও তার অংশীদারেরা যাবতীয় লাভের অধিকারী হচ্ছে অথচ স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিরা এর সব নেতিবাচক ফল ভোগ করছে।

রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধান ও প্রটোকল অগ্রাহ্য করে টিলা কেটে চলছে সাদা মাটি আহরণ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেশি মাটি উত্তোলন করে সময়মতো তা অপসারণ না করতে পেরে উত্তোলনস্থলে মাসের পর মাস স্তূপ করে ফেলে রাখা হচ্ছে। আবার উত্তোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে যে মাটি তোলা হয়, সেটা কাজে লাগে না বলে এখন কৃষিজমিতে ফেলে রাখা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শুধু মূল্যবান সাদা মাটি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, উত্তোলনের যে নানামুখী প্রভাব রয়েছে, সেসব একেবারেই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। আহরণস্থলে সরকারি কোনো তদারকি নেই। ইতিমধ্যে সেখানকার প্রতিবেশ ও জনজীবন বিপন্নতার মুখোমুখি।

পাহাড় ও পাহাড়ি বনের ওপর নির্ভরশীল হাজং, মান্দি ও অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে: বন ও গাছপালা ধ্বংসপ্রাপ্ত, বহু বন্য প্রাণী বিলুপ্ত, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন, পানিদূষণ, খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত। কিছুদিন আগেও যেখানে খরগোশ পাওয়া যেত, সেখানে আর খরগোশ পাওয়া যায় না; খননের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় কৃষিকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ভারী যানবাহনের কারণে শব্দদূষণ ও রাস্তাঘাট ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। যে পাহাড় ও বন এই অঞ্চলের জানা ইতিহাসের পুরোটা সময় হাজং, গারো ও অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর জন্য ছিল বাসযোগ্য নিজস্ব আবাসভূমি, সেটাই এখন অপরিকল্পিত ও নির্বিচার সাদা মাটি আহরণের ফলে তাদের জন্য ক্রমে অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে।

নির্বিচার পাহাড় ও টিলা কেটে সাদা মাটি উত্তোলনের সাক্ষী আজও বহন করে চলেছে দুর্গাপুরের সাদা মাটি এলাকাগুলো। প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত, দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে, এ দৃশ্য ভয়ংকর ও বীভৎস। খননের পর সেটি আবার ব্যবহারোপযোগী এবং গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলার কোনো দায়দায়িত্ব খননকারী কোম্পানিগুলো বহন করেনি। এগুলো খোলা পড়ে আছে, কোনো সতর্কবার্তাও নেই। দুর্ঘটনাপ্রবণ এসব খাদে পড়ে ও পানিতে নেমে বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশু ও পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় সাংবাদিকেরা আমাদের জানিয়েছেন, ১৯৭৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৭ জন মানুষ এসব মৃত্যুকূপে মারা গেছেন। এই প্রাকৃতিক সম্পদ স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো উপকারে তো আসছেই না, বরং আক্ষরিক অর্থেই তাদের জীবন ও সম্ভাবনা ধ্বংস করছে।

দুর্গাপুর উপজেলার নেথপাড়া গ্রাম থেকে হদি জনগোষ্ঠীর একটি পাড়া পুরোপুরি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। গত দুই দশকে কয়েক দফা বাস্তুচ্যুতির ফলে এসব পরিবারের কোনো হদিসও আর এলাকাবাসী দিতে পারেননি। অন্যদিকে, একই উপজেলার রানীখং ইউনিয়নের বগাউড়া গ্রাম থেকে গত ১৫ বছরে ১১টি হাজং পরিবার নিজ ভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিছু পরিবার সেখান থেকে উচ্ছেদ বা সাদা মাটি উত্তোলনের জন্য নিজ ভূমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই জায়গাও চলে আসছে সাদা মাটি উত্তোলনকারীদের কবজায়। আর এভাবে যদি তাঁরা জবরদখলের শিকার না-ও হন, খাদ ও ভূমিধসের আবর্তে পড়ে ধসে যাচ্ছে স্থানীয় জনজীবন।

কী পরিমাণ সাদা মাটি উত্তোলন করা হয়েছে, তা তদারকির কোনো কৌশল বিদ্যমান না থাকায় কোনো কোম্পানি প্রশাসনিক অনুমতি পেলে তার পক্ষে ইচ্ছামাফিক খনন ও উত্তোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কিছুদিন পর এই অঞ্চলে আদৌ কোনো টিলা ও টিলার বাস্তুসংস্থান অবশিষ্ট থাকবে কি না সন্দেহ। এখানকার খননকারী কোম্পানি ও তার অংশীদারেরা যাবতীয় লাভের অধিকারী হচ্ছে অথচ স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিরা এর সব নেতিবাচক ফল ভোগ করছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই:
১.পরিবেশগত সুরক্ষার প্রশ্ন বিবেচনায় না নিয়ে অপরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের যে আয়োজন, তা বন্ধ করতে হবে। দুর্গাপুরের তিনটি মৌজায় বন্ধ হলেও পার্শ্ববর্তী ধোবাউড়ায় তা অবাধে চলছে। আমরা মনে করি, পুরো অঞ্চলেই এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
২.সাদা মাটি উত্তোলনের ফলে যেসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে।
৩.ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যক্তিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৪.পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্য ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫.পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারসাম্যহীন উপায়ে যেভাবে খননকাজ করা হয়েছে এবং খননের পর বিদ্যমান কোনো প্রটোকল না মেনে সংশ্লিষ্ট জায়গা যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, একে পুনরায় জীববৈচিত্র্যের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে এবং এর আর্থিক দায়ভার খননকারী প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।

৬.খননের ফলে সৃষ্ট খাদ বা খাদের পানিতে পরে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমরা মনে করি, অবিলম্বে সেখানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা যায় এবং এ পর্যন্ত যাঁরা নিহত হয়েছেন, সেই সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭.পাশাপাশি আমরা মনে করি, সোমেশ্বরী নদীতে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, সেটাও পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান
৮. প্রটোকল মেনে চলা উচিত। বালুর ট্রাক চলাচলের ফলে দুর্গাপুরবাসী প্রতিদিন যে দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হন, তা লাঘব করার জন্য দ্রুত বাইপাস সড়ক নির্মাণ খুবই জরুরি।
৯.প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনজীবন ও প্রতিবেশের ওপর যেন প্রতিকূল প্রভাব না পড়ে, তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করা।
১০.খননকাজের সময় স্থানীয় পর্যায়ে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো মনিটরিং থাকে না। মনিটরিং থাকা অত্যন্ত জরুরি। পর্যটন ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কাজের সমন্বয় থাকাও খুব দরকার।
১১. মাটি উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপযুক্ত মজুরি প্রাপ্তি এবং স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যমান আইএলও কনভেনশন একদমই মানা হচ্ছে না। শ্রমিকদের এ স্বার্থের বিষয়টিও দেখার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।

এ অঞ্চলে বাঙালি ছাড়াও হাজং, গারো, হদি, বানাইসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাস করে, যাদের জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন, রান্নার জ্বালানি ও সুপেয় পানির সংকট রয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার সীমিত। তাদের জীবনমান উন্নয়নে, তাদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণে, তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণে, শিক্ষার প্রসারে এবং তাদের নারীর নিরাপত্তা ও শিশুর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, লেখক-সাংবাদিক, আইনজীবী, আদিবাসী নেতা, গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।