দুই কৃষকের আত্মত্যাগের ঋণশোধ যেভাবে সম্ভব

কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনায় স্বজনদের আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো

এবার আন্তর্জাতিক ২২ মার্চ পানি দিবসের মূল বিষয় ছিল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে। এর দুই দিন পর রাজশাহীতে দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। পরিবার বলেছে সেচের পানি না পেয়ে তারা আত্মহত্যা করেছে। শুধু পানি দিবস নয়, এটা মার্চ মাস, স্বাধীনতার মাস। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তীর ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সাহস দেখিয়েছিল। এই বরেন্দ্র অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মোৎসর্গ করেছে। এই সময় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করলেন দুজন আদিবাসী দরিদ্র কৃষক ।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ হাজার গভীর নলকূপ পরিচালনা করছে। এর মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পানির সমস্যা বেশি। অভিযোগ আছে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিএমডিএ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর ফলেই বরেন্দ্র অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কৃষকের এই মৃত্যু। এ কারণে থানায় মামলা হয়েছে। এটা আইনি প্রক্রিয়ায় চলতেই থাকবে।

কিন্তু এই ঘটনা সমগ্র উত্তরাঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ফাঁদ ও দুর্বৃত্তায়ন দেখে মনে হয়েছে বরেন্দ্র প্রকল্প ১৬টি জেলায় নতুন এক শোষক শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। এরা অনেকটা একদিকে ভূমি সামন্ত, অন্যদিকে পানি সামন্তে পরিণত হয়েছে। এটা একটা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। তাই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন পাম্প চালক এর আসামি হলেও প্রকৃতপক্ষে বিএমডিএ এর প্রতিটি স্তরের স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দুর্নীতি এর জন্য দায়ী। কার্যত বরেন্দ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখন আসামির কাঠগড়ায় ।

খবর পাওয়া মাত্র আমি নিজে ঘটনাস্থল ও এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি পরিদর্শন করি। দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘটু গ্রামে অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডির বাড়িতে যাই। ক্রন্দনরত স্বজনেরা অভিযোগ করে ১২ দিন ধরে পানির জন্য অনুরোধ করেও পানি না পেয়ে রাগে, অভিমান ও ক্ষোভে যে জনগোষ্ঠী বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষির প্রাণ সেই জনগোষ্ঠীর কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডিকে আত্মহত্যা করতে হলো। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পরিষ্কারভাবে বলা যায় ওই দুটি আত্মহত্যা সামগ্রিক ঘটনার যে ভয়াবহতা ও অমানবিকতা তার একটি প্রকাশ মাত্র। বিএমডিএ’র অব্যবস্থাপনা এই অঞ্চলের সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ভয়াবহ ভবিষ্যতের সতর্ক বার্তা।

দুই কৃষকের মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিল রাষ্ট্র সব মানুষের সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সংবিধান উপেক্ষিত হয়েছে। আজকে বাস্তবতা-রাজনৈতিক দুষ্ট চক্রের প্রতিপত্তির ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর মুনাফা লোভী ও স্বার্থবাদীদের হুমকির মুখে রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকদের পানির ন্যায্য অধিকার।

আমাদের সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বৈষম্যহীন আচরণের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট প্রত্যয় রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায় পানি ব্যবস্থাপনার আইননীতি এড়িয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টি সম্মুখে এসেছে। পাম্প চালকের রাজনৈতিক পরিচয় এর বাস্তবতা প্রমাণ করে। দেশে পানি ব্যবস্থাপনায় যে কোনো আইন বা নীতি নেই, তা নয়। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি ঘোষিত হয়েছে। ২০১৩ হলো পানি আইন। আর ২০১৮ সালে এমনকি এর বিধিমালাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে তাদের নিজস্ব মর্জি অনুসারে এক অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করেছে।

এই আইন অনুসারে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদও যুক্ত থাকার কথা। পানি আইনের নীতি নির্দেশনা অনুসারে পানি সম্পদের সমন্বিত ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই সরকারের আমলে প্রণীত আইনও উপেক্ষিত। সমন্বিত উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সমবায় ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার পথ বেছে নিতে পারতেন যা আমাদের সংবিধানে আছে। তাহলে আজকে আমাদের প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্র কোন পথে চলছে?

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ১৬ হাজার গভীর নলকূপ রয়েছে। দুই বিভাগেই পানির গভীর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বলা যায় দেশের উত্তরাঞ্চল পানি সম্পদ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি।যাকে মরুকরণের প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের সারা দেশের তুলনায় ৪০ ভাগ বৃষ্টিপাত কম হয়। বর্ষকালেও এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে হয়। প্রতি বছর ১ ফুট করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এক দশক আগেও তা ছিল ৬ ইঞ্চি। এখানে পানির স্তরের যে বৈশিষ্ট্য তাতে ১৬০ ফুট নিচেই কেবল মাত্র পানি পাওয়া যায় এবং সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে।

বরেন্দ্র প্রকল্পের এই নেতিবাচক দিক নিয়ে বর্তমান সরকারের সময়েও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে পরিস্থিতির ভয়াবহতার সম্পর্কে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের এই জেলাগুলোতে খাল-বিল, নদী-নালা এমনকি পুকুর, অগভীর নলকূপ এর ওপর যে প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। সমগ্র উত্তরাঞ্চল জুড়ে পদ্মা-যমুনা-তিস্তা-আত্রাই-মহানন্দা ইত্যাদি নদী প্রবহমান। আমরা সহজেই উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করতে ভূ-উপরস্থি পানি সেচ কাজে ব্যবহারের পথ বেছে নিতে পারি। সংসদে আমরা উত্তর পশ্চিম সেচ প্রকল্পের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব বারবার উপস্থাপন করেছি। সে প্রস্তাব হয়তো এখনো ফাইলের স্তূপের নিচে।

দুই কৃষকের মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিল রাষ্ট্র সব মানুষের সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সংবিধান উপেক্ষিত হয়েছে। আজকে বাস্তবতা-রাজনৈতিক দুষ্ট চক্রের প্রতিপত্তির ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর মুনাফা লোভী ও স্বার্থবাদীদের হুমকির মুখে রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকদের পানির ন্যায্য অধিকার।

এখন সময় এসেছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরে নির্ভরশীলতার কমিয়ে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে নদী, জলাশয়ের পানি এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভূ-উপরস্থি পানির ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীলতা নিশ্চিত করা। নিশ্চিত করতে হবে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকার। পানি ব্যবস্থাপনায় ছোট-বড় সকল কৃষকের সমবায় সৃষ্টি করে সকলের পানির অধিকারের ন্যায্যতা গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই এই দুই আদিবাসীর আত্মত্যাগ ও তাদের ঋণ পরিশোধ সম্ভব।

ফজলে হোসেন বাদশা সংসদ সদস্য এবং আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহবায়ক