দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। আগের নির্বাচনের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। আরও অতীত নির্বাচনী ইতিহাসের সঙ্গেও এটা বেশ বেমানান। ভোটের কমতি হয়তো এটা রাজ্য ভোট বলে। বিধানসভার নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের উত্তেজনা কম থাকে বলেই ৩৭ শতাংশ ভোটার হয়তো উৎসাহবোধ করেননি কেন্দ্রে যেতে। অথবা ভোটারদের একটা অংশ হয়তো দ্বিধান্বিত ছিল কাকে ভোট দেবে, সে বিষয়েও।
তবে কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো কম ভোটের এই নির্বাচনেই তুলনামূলকভাবে বেশি ভোট পড়েছে সংখ্যালঘু ভোটার বেশি আছে—এমন এলাকায়। দিল্লির মুস্তফাবাদ, মাটিয়ামহল ও সিলামপুরের মতো মুসলমান–অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ৬৫ থেকে ৬৬ শতাংশ করে ভোট পড়েছে। এর মানে দাঁড়ায়, সংখ্যালঘু ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
রাজ্যের ভোটে সংখ্যালঘুদের এই উৎসাহের মূলে ছিল জাতীয় রাজনীতির বিবেচনা। অনেকেই বলছেন, দিল্লির ভোট কেবল দিল্লির ছিল না। ভারতের সাম্প্রতিক প্রতিটি ভোট উৎসব এখন ‘বিজেপি বনাম অন্য’দের লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে। সেটা ছাত্র সংসদ, কলকারখানার সিবিএ ইউনিয়ন, বিধানসভা কিংবা লোকসভা নির্বাচন—যেটাই হোক।
আয়তনে ভারতের সবচেয়ে ছোট রাজ্য গোয়া। ‘জাতীয় রাজধানী অঞ্চল’ হিসেবে দিল্লি তার অর্ধেকেরও কম। ৫৪৫ আসনের লোকসভায় দিল্লির জন্য রয়েছে মাত্র ৭টি আসন। অর্থাৎ ১ শতাংশের সামান্য বেশি। এ রকম একটি এলাকার নির্বাচন নিয়েই গত এক মাস ভারতজুড়ে অভাবনীয় উত্তেজনা ছিল। এর কারণ নিশ্চিতভাবে জাতীয় রাজনীতি। এটা অস্বাভাবিকও নয়।
আয়তনে ছোট হলেও দিল্লিতেই রয়েছে ভারতের সব অঞ্চলের মানুষ। দিল্লি এক অর্থে ‘মিনি ভারত’। ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন তাই এক অর্থে ভারতীয় রাজনীতির একটা ‘মিনি গণভোট’ ছিল। তাতে মোদি-অমিত শাহ জুটি হেরে গেছে। আবার আম আদমি পার্টি (এএপি) একা জিতেছে, সেটাও বলা যায় না।
সিএএ-এনআরসিবিরোধী তরুণদের পক্ষে দিল্লিবাসীর রায়
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ভারতে সামাজিক বিভক্তি বাড়িয়ে চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) কেন্দ্র করে ছাত্র-তরুণদের বিক্ষোভ। দীর্ঘস্থায়ী ও প্রথাবিরোধী এই জন-আন্দোলন আরএসএস-বিজেপির রাজনীতিকে সামাজিক পরিসরে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ফল হিসেবে ভারতের আর্থসামাজিক পরিসরের সবকিছুতে এখন ‘জাতীয়’ মাত্রার রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কথা এএপি ও বিজেপির মধ্যে। নির্বাচনী ইস্যু হওয়ার কথা ‘স্থানীয় বিষয়’। আঞ্চলিক দল এএপি বা আপ বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখানে। তারপরও নির্বাচনটি হয়ে গেছে বিজেপি বনাম ‘সবার’ মধ্যে। দিল্লির জনজীবন আগামী পাঁচ বছর কে পরিচালনা করবেন, তার চেয়েও নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে কে সিএএ-এনআরসির সমর্থক আর কে নয়। ফলাফল সেভাবেই হয়েছে। এই লেখা তৈরির সময় ৭০ আসনের মধ্যে বিজেপি ১৪টিতে এগিয়ে ছিল। এএপি ৫৬টিতে। মাত্র ৩৬টি জিতলেই যেখানে সরকার গড়া যায়, সেখানে দিল্লি ‘গণভোটে’ বিজেপিবিরোধীদের বিজয়কে বিপুলই বলতে হবে।
দিল্লি হয়ে উঠেছিল জাতীয় নির্বাচনের রণক্ষেত্র
লোকসভায় তিন শতাধিক আসনের জোরে বিজেপি ভারতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়। ২৮টি রাজ্যের মধ্যে অন্তত ১৬টিতে বিজেপি ও তার মিত্ররা সরকার চালাচ্ছে। দিল্লির সব লোকসভা আসনও তাদের দখলে। সব মিলে দেশটিতে ক্ষমতাচর্চার সব স্তরে তাদের প্রবল ও ঝুঁকিমুক্ত রাজনৈতিক আধিপত্য আছে। আজকের নির্বাচনী ফল তাদের জন্য মোটেই জীবন–মরণ বিষয় ছিল না। দিল্লিতে তারা এত দিন ক্ষমতায়ও ছিল না। এখানে হার তাদের জন্য তাই বড় কিছু ‘হারানো’ নয়। গত নির্বাচনে তারা ৭০ আসনের বিধানসভায় মাত্র ৩টি আসন পেয়েছিল।
তারপরও বিজেপি এই নির্বাচনকে অবিশ্বাস্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তোলে। দলীয় প্রায় ২৫০ জন লোকসভা সদস্যকে তারা নির্বাচনকালে প্রচারে নামায়। এক হিসাবে দিল্লির সাতটি লোকসভা আসনের প্রতিটিতে বিজেপির তিন থেকে চারজন করে সাংসদ স্থানীয় এই নির্বাচনের প্রচারে নামেন। পার্টির সাবেক প্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাড়ি বাড়ি প্রচারে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী মোদিও দুটি সভায় এসেছিলেন। এসবই ঘটেছে জাতীয়ভাবে সিএএ-এনআরসিবিরোধী আন্দোলনকে নৈতিকভাবে পরাস্ত করতে। যেহেতু এই আন্দোলনের মধ্যে এই নির্বাচন হচ্ছে এবং দিল্লির সমাজজীবন গভীরভাবে এই আন্দোলনে উত্তাল, সে কারণে আরএসএস-বিজেপি পরিবার নির্বাচনকে গ্রহণ করেছিল আন্দোলন দমনের উপায় হিসেবে। কিন্তু বিজেপির এই আকাঙ্ক্ষা পরাস্ত হয়েছে।
যদি সিএএ-এনআরসিকে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতেই হবে দিল্লিবাসী সিএএ-এনআরসির পক্ষে নয়। দিল্লির এই নির্বাচনী বার্তা অমিত শাহ-মোদি জুটির জন্য একটা বড় নৈতিক পরাজয়ই বলতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনে পরিণত করে নিজেরাই তাঁরা সেই পরাজয় ডেকে এনেছেন।
হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করার কৌশল পুরো সফল হয়নি
ভারতে দুই মাস ধরে সিএএ-এনআরসিবিরোধী যে আন্দোলন চলছে, তার বড় এক ভরকেন্দ্র দিল্লি। এখানকার শাহিনবাগেই ১৫ ডিসেম্বর থেকে নারীদের দীর্ঘস্থায়ী জমায়েত চলছে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে। ক্রমে এই আন্দোলন মোদি সরকারবিরোধী জন-আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। একই মডেলে ভারতের আরও অনেক শহরে লাগাতার জমায়েত চলছে এখন।
সাধারণভাবে ‘শাহিনবাগ’ সিএএ-এনআরসিবিরোধী সব ধর্মের আন্দোলনকর্মীদের জীবন্ত প্রতীকে পরিণত হলেও এই আন্দোলন শুরু করেন মুসলমান নারীরা। মুসলমান সম্প্রদায়ের হলেও এই নারীসমাজের হাতে দেখা গেছে গান্ধী ও আম্বেদকরের ছবি। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের পুরোনো অসাম্প্রদায়িক আবহ ফিরিয়ে আনাই তাঁদের মূল দাবি। তবে আরএসএস-বিজেপি পরিবার শাহিনবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের মুসলমান পরিচয়কে নির্বাচনে প্রধান ইস্যু করতে চেয়েছিল।
নির্বাচনকে হিন্দু-মুসলমান ভোটের সমীকরণে বিভক্ত করার কৌশল হিসেবে এই চেষ্টা নেয় তারা। এ কাজের জন্য উত্তর প্রদেশ থেকে যোগী আদিত্যনাথকে নিয়ে আসা হয়। ১২টি নির্বাচনী সভা করেছেন তিনি। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় মূল লক্ষ্য ছিল শাহিনবাগের উদাহরণ ও বিবরণ দিয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের উত্তেজিত করা এবং ভোটে তার ফায়দা নেওয়া। বিজেপি জানে, দিল্লির ৮৭ শতাংশ ভোটার অমুসলিম। ১৩ শতাংশের বিরুদ্ধে যদি ৮৭ শতাংশকে এক কাতারে আনা যায়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হবে না। এই কৌশল কাজ করেনি।
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দিল্লিতে ভোট পেয়েছিল ৫৭ শতাংশ। এবারে এখন পর্যন্ত প্রাপ্তি ৪০ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, এক বছর না পেরোতেই সেই জোয়ার তারা ধরে রাখতে পারেনি। বার্তাটি তাই স্পষ্ট। সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে নাগরিক সেবা ও নাগরিক স্বার্থের রাজনীতিতে মনোযোগী হতে হবে বিজেপিকে।
তবে এটা ভাবাও ঠিক হবে না, দিল্লিতে বিজেপিবিরোধী সব ভোট মোদি সরকারবিরোধী চরিত্রের। দিল্লির অনেক বাসিন্দা এএপির গত পাঁচ বছরের কাজকেও ভোটের মাধ্যমে সমর্থন জানিয়েছেন। এএপি কিছু ভোট অবশ্যই পেয়েছে গত ছয় বছরের প্রশাসনিক সুশাসনের জন্য। একটা স্থানীয় নির্বাচনে পানি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনার বাইরে রেখে সবাই জাতীয় ইস্যুতে ভোট দিয়েছে, এমন ভাবার সুযোগ কম। এএপি এসব নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এমন কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল, যা ভারতজুড়ে প্রশংসিত। এএপি সিএএ-এনআরসি ইস্যুতেও প্রবল বিরোধী নয়। সিএএ-এনআরসিবিরোধী তরুণদের ওপর দিল্লিতে পুলিশি আক্রমণে কেজরিওয়াল প্রকাশ্যে প্রবল কোনো অসন্তোষ জানাননি। বাবরি মসজিদের স্থলে মন্দির নির্মাণের রায়েও এএপি সমর্থক। কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা হরণের উদ্যোগেও তারা মোদি সরকারের কাছাকাছি ছিল। ফলে, দিল্লিতে তৃতীয়বারের মতো জিতে আসার পথে তাদের পাওয়া সব ভোট সিএএ-এনআরসি বিরোধী, এমন নয়। মুসলমানরা তাদের অন্ধভাবে ভোট দিয়েছেন, এমন ভাবারও সুযোগ কম। দিল্লির যেসব অঞ্চলে নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলন প্রবল ছিল, সেখানে এএপির সংখ্যালঘু প্রার্থীরা জিততে চলেছেন। আবার পুরো রাজ্যে আগের চেয়েও বিজেপির আসন বাড়া প্রমাণ করছে, তারা আগের অবস্থা থেকে কিছুটা এগিয়েছে। হিন্দুত্ববাদ দিল্লি একদম ছুড়ে ফেলেছে, এমনও নয়।
কংগ্রেস পুনর্গঠিত হতে পারল না
দিল্লির এই নির্বাচনের তৃতীয় শক্তি ছিল গান্ধীদের জাতীয় কংগ্রেস। এএপি সরকারের আগে ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তারাই দিল্লিতে সরকার পরিচালনা করেছে। কিন্তু দলটি এখন দিল্লি থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। ২০০৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা ভোট পায় ৪০ শতাংশ। পরের নির্বাচনে ২৫ শতাংশ। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ১০ শতাংশ। এবারে এখন পর্যন্ত কমবেশি ৪ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, কংগ্রেসের অতীত ভোটগুলোই এখানে এএপি পাচ্ছে। বিজেপি ও এএপি যেভাবে এই নির্বাচনকে প্রায় যুদ্ধে পরিণত করেছিল, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেভাবে তাতে শামিল হতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচারে তাঁদের অল্প উপস্থিতি ছিল। পুরো বিষয়টি সামাল দিয়েছে স্থানীয় নেতৃত্ব। নির্বাচনে কংগ্রেস কেজরিওয়ালের বিপরীতে কাউকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবেও তুলে ধরতে পারেনি। কেবল তাদের অতীত শাসনামলের উদাহরণ টেনেছে।
অথচ ভোটারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। এসবের কারণে জরিপকারীদের পূর্বানুমানই সত্য হয়েছে। প্রাথমিক গণনায় কংগ্রেস মাত্র একটি আসনে এগিয়ে ছিল কিছু সময়। ভারতের রাজধানীতে অস্তিত্বহীনতার ঝুঁকিতে পড়েছে তারা। সংখ্যালঘু ভোটারদের এলাকাতেও অতীতের মতো আর ভোট পায়নি দলটি।
কংগ্রেসের এই বিপন্নতা এই নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপি পরিবারের বড় প্রাপ্তি। এএপি জাতীয়ভিত্তিক কোনো দল নয়। জাতীয় পর্যায়ে তারা মোদিবিরোধী জোটেও নেই। তাদের বিজয় বিজেপির জন্য জাতীয় কোনো বিপর্যয় নয়; বরং দিল্লিতে কংগ্রেসের খারাপ ফল বিজেপির জন্য আনন্দদায়ক। এটা প্রমাণ করছে, মানুষ বিজেপিবিরোধী ভরসা হিসেবে কংগ্রেসকে গ্রহণ করছে না। কংগ্রেসের বাইরে ভারতজুড়ে আপাতত একক কোনো বিরোধী দলও নেই। বিজেপির জন্য এটা বড় ভরসার দিক।
ফলে, মিনি ভারত দিল্লির ‘খণ্ডযুদ্ধে’ হারলেও মোদি-অমিত শাহ জুটি দীর্ঘ মেয়াদে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বীও থাকছে। পাঁচ বছর আগের চেয়ে খারাপ করেনি তারা। পুরোনো ভোটও হারায়নি।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক