১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রায় নয় মাসের বন্দিদশা কাটিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিকেলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁকে দেখার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল। পাকিস্তানকে লক্ষ করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছ, আমাদের মা-বোনদের বেইজ্জত করেছ, অগুনতি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছ এবং এক কোটি লোককে দেশান্তরি হতে বাধ্য করেছ। তারপরও বলছি, তোমাদের বিরুদ্ধে আমার মনে কোনো দ্বেষ নেই। তোমরা স্বাধীন থাকো। আমাদের স্বাধীনভাবে থাকতে দাও। তোমাদের সঙ্গে সবকিছু চুকেবুকে গেছে।’
শেখ মুজিবের কণ্ঠে ছিল রিকনসিলিয়েশন বা বিরোধ মিটিয়ে ফেলার সুর। পাকিস্তান সরকার তার মূল্য দেয়নি, হয়তো বোঝেইনি। পুরোনো ক্ষতটাকে তারা বারবার খুঁচিয়ে যন্ত্রণা বাড়িয়েছে। সর্বশেষ আলামত আমরা দেখলাম গত ১৬ নভেম্বর, আমাদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটা খবরে। দ্য স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সূত্র উদ্ধৃত করে পাকিস্তানি দৈনিক দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে ১৫ নভেম্বর ছাপা হওয়া খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তান নাকি আমাদের কাছে অনেক টাকা পায়, ৭০০ কোটি টাকার মতো। পাকিস্তান এই টাকা শিগগিরই বাংলাদেশের কাছে দাবি করতে যাচ্ছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ কাছে ‘পশ্চিম পাকিস্তানের’ পাওনা হলো বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ৯২১ কোটি পাকিস্তানি রুপি, যা প্রায় ৮ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের সমান।
অর্থের অঙ্কটা খুব বেশি নয়। কিছুদিন আগে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। তবে অর্থের পরিমাণ যা-ই হোক, প্রশ্নটা হলো ন্যায্যতার। পাকিস্তানের এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক? আমরা বিষয়টির বিস্তারিত জানি না। কেননা, পাকিস্তান সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি তোলেনি, কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি। কিন্তু পাকিস্তানি দৈনিকের খবর ইতিমধ্যে ঢাকায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। টক শোতে আলোচনার খোরাক হয়েছে। একটা টক শোতে এমন প্রশ্নও উঠেছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত কি না।
কিছুদিন আগে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। ইসলামাবাদে যে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমাদের যোগ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে তখন আবহাওয়া ছিল উত্তপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল সপ্রতিভ, কুশলী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্প্রতি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এহেন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ছিল কূটনীতির মার্জিত ভাষা। টক শোর হইচই কিংবা রাজপথের উত্তেজনাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে কূটনৈতিক যুদ্ধে জেতা যায় না। তবে এসব উত্তেজনারও মূল্য আছে। জনমানুষের আবেগ-অনুভূতি উপেক্ষা করা চলে না। আবার এই আবেগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সামাল দেওয়াও যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করার সময় আমরা জেনেছিলাম, ‘লুইস মডেলের’ আলোকে পাকিস্তানের অর্থনীতি সাজানো হচ্ছে। এই তত্ত্বের মাজেজা হলো—পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ হবে শিল্পে এবং পূর্ব পাকিস্তানে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কৃষকই জাতির মেরুদণ্ড—এই আপ্তবাক্য শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। তো একপর্যায়ে দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ল। টার্মস অব ট্রেডের জাঁতাকলে পড়ে আমাদের কৃষিপণ্য মার খেতে থাকল এবং শিল্পপণ্যের বাজার বিস্তৃত করে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি তরতরিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেল। আইয়ুব খানের ‘উন্নয়ন দশকের’ শেষ বছরে ১৯৬৮-৬৯ সালে দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হলো প্রায় ৮৭ কোটি টাকার পণ্য। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি হলো প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার মালামাল। অর্থাৎ বাণিজ্যের ভারসাম্য থাকল পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে—১.৫: ১ (সূত্র: লে. জে. কামাল মতিনউদ্দিন, ট্র্যাজেডি অব এরর গ্রন্থ)।
পূর্ব পাকিস্তানের পাট বেচা ডলারে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কলকারখানার যন্ত্রপাতি আর কাঁচামাল আমদানি করা হতো। ফলে ওখানে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়ে যায় অনেক। সম্পদ পাচারের এই প্রবণতা অবশ্য নতুন ছিল না। একসময় বাংলার কৃষকের খেতের ফসল আর কারিগরের হস্তশিল্প লুটে নিয়ে কিংবা ধ্বংস করে লন্ডন আর কলকাতা রোশনাই হয়েছিল। বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম দুর্ভিক্ষ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাচারের রুট বদলে যায়। আমাদের হাড়-মাংস নিংড়ে ইসলামাবাদে চাকচিক্যময় আধুনিক নগর গড়ে ওঠে। আমরা পাই ছোটখাটো ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ আইয়ুব নগর। এখন এটা হয়েছে শেরেবাংলা নগর। বাংলাদেশের পাট, চা আর তামাক বেচা টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পদের বণ্টন নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তার সমাধান হয়নি। ভারত পাকিস্তানকে একটি টাকাও দেয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর অভিন্ন পাকিস্তানের সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নটি উঠেছিল যৌক্তিকভাবেই। ১৯৪৭ সালে নয়াদিল্লি যা করেছিল, ১৯৭২ সালে ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষ সে পথেই হাঁটল। সম্পদের ওপর বাংলাদেশের দাবি পাকিস্তান সরকার বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে।
১৯৭২ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সদস্য হওয়ার সময় একাত্তর-পূর্ববর্তী পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের দায় কে নেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশ্বব্যাংক ছিল বড় দাতা। দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের মধ্যে বড় শরিক ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স। ওই সময় দাতাদের চাপে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চলমান প্রকল্পগুলোর ঋণের দায় নিতে রাজি হয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বরাবরই বলে এসেছে, একাত্তর-পূর্ববর্তী সব দায়দেনা পাকিস্তানকেই মেটাতে হবে।
১৯৭৪ সালে করা এক হিসাবে দেখা যায়, পাকিস্তানের সম্পদে বাংলাদেশের দাবির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। এর সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক দাম ধরা হয়েছিল আরও ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ডলার। ১৯৭১-৭২ সালের মূল্যমান অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট প্রাপ্য হিসাব করা হয়েছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার। পরে কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এ চৌধুরী ও এস এ বাশারের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদ ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিদেনপক্ষে ২ হাজার কোটি ডলার এবং মানবসম্পদের ক্ষতি ১০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের কম নয়।
একাত্তরে পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় পাকিস্তান বেশ কিছুদিন তার দায়দেনা পরিশোধ করেনি এবং একপর্যায়ে দেনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করেছিল। দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানের প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। তারা বেশ কয়েকবার দেনা পরিশোধের সময়সীমা পরিমার্জন করেছিল। অন্যদিকে দেনার একটা অংশ যাতে বাংলাদেশ বহন করে, সে জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কথা হয়। শেখ মুজিব দৃঢ়তার সঙ্গে এই দায় নিতে অস্বীকার করেছিলেন।
দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া অব্যাহত রাখলেও দেনা পরিশোধের জন্য চাপও বজায় রেখেছিল। চুয়াত্তর সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে এই চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এবং শেষমেশ একাত্তর-পূর্ববর্তী পাকিস্তানি ঋণের মধ্যে থেকে ৩৫ দশমিক ৫৬ কোটি ডলারের দায় মেনে নেয়। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বাংলাদেশ থেকে ১২০ কোটি ডলার আদায় করতে চেয়েছিল (সূত্র: নুরুল ইসলাম, মেকিং অব অা নেশন)।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু পাকিস্তানের সম্পদের ওপর তার দাবি থেকে পিছু হটেনি। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশকে পাকিস্তান কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ সরকার আশা করেছিল, এ বিষয়ে একটা সুরাহা হবে। জুন মাসে ভুট্টোর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল: ১. পাকিস্তানের সব সম্পদ ও দায়দেনা উভয় দেশ সমান ভাগ করে নেবে; ২. ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটা যৌথ কমিশন গঠন করা হবে; এবং ৩. পাকিস্তান সৌজন্য দেখিয়ে প্রতীকী অর্থে ২০ থেকে ৩০ কোটি ডলার দেবে দুই মাসের মধ্যে। এ হিসাবটা করা হয়েছিল দৃশ্যমান সম্পদকে বিবেচনায় রেখে, যেমন স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, বেসামরিক বিমান এবং সমুদ্রগামী জাহাজ। বাংলাদেশ অনুরোধ করেছিল, দূতিয়ালি করার জন্য প্রয়োজনে সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই তিনটি দেশের যেকোনো একটিকে জড়াতে।
পাকিস্তানের সঙ্গে তিক্ততা ভুলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে এটা ছিল একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শেখ মুজিবের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ভুট্টো গ্রহণ করেননি। তিনি এ নিয়ে আলোচনা করতেই রাজি হননি। এ নিয়ে কোনো যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে তেতো সম্পর্কটা ৪০ বছরেও কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। ভুট্টো সাড়া না দিলেও বাংলাদেশ সরকার নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে সম্পদের দাবি তুলেছিল। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় শেখ মুজিব বিষয়টি তুলেছিলেন। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে লন্ডনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে বিষয়টি আবারও তোলা হয়।
পঁচাত্তরের জুলাই মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ আবারও সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চায়। কিন্তু ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও কূটনীতির ব্যাকরণ আমূল পাল্টে যায়। সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টা চলে যায় হিমঘরে। পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে যতগুলো শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, তার কোনটায় এ বিষয়টি নিয়ে কী কথা হয়েছে, তা এখন খতিয়ে দেখা দরকার।
একপর্যায়ে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ বুঝি তার দাবি থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এখন পাকিস্তান যদি উল্টো দাবি করে বসে, তাহলে আমাদের তো নড়েচড়ে বসা দরকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টা কীভাবে দেখা হচ্ছে, সরকারের কৌশল কী, তার ব্যাখ্যা থাকা দরকার। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেও বাংলাদেশ তার দাবির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ তার পরম শত্রুর সঙ্গে কূটনৈতিক লড়াই এবং সাংস্কৃতিক বাণিজ্যিক লেনদেন একই সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেন পারব না?
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে আপস করা উচিত হবে না। আমরা ঝগড়া করব না, দাবিও ছাড়ব না। কারণ, এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা, আমাদের গরিব কৃষকের ঘাম আর রক্তের দামে কেনা। কাজী নজরুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে আমরা বলতেই থাকব: দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com