দেশের গ্রীষ্মকাল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। যে দেশ একসময় ষড়্ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই দেশে এখন কার্যত তিনটি ঋতু—গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। বাকি তিনটি ঋতুর বৈচিত্র্য আমাদের জাতীয় জীবন থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। এটা এখন সবাই জানে। খবর হলো, বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবনযাত্রার মানও পড়ে যাচ্ছে।
তবে এটা শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নয়, গত দুই বছরে বিশ্বের শীতপ্রধান অঞ্চলেও অভূতপূর্ব গ্রীষ্মকাল অনুভূত হয়েছে।
২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মকাল যেন শেষই হচ্ছিল না। এ বছর প্যারিসের তাপমাত্রা স্মরণকালের সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে ওঠে। আর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির তাপমাত্রা ওঠে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮১-২০০০ কালপর্বের তুলনায় ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে, যদি কার্বন নিঃসরণ কমানোর যথাযথ বা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৮০ কোটি মানুষ এখন রীতিমতো ‘হটস্পটে’ বসবাস করছে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এই অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন যেমন কমবে, তেমনি স্বাস্থ্যহানি থেকে উৎপাদনশীলতা কমবে। সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, দারিদ্র্যবিমোচনে দক্ষিণ এশিয়া এত কষ্ট করে যে সফলতা অর্জন করেছে, সেই সফলতা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে কেবল এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের উপার্জন প্রায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। ভারতের বেলায় তা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার বেলায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে।
তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মানুষের ভোগব্যয় কমে যেতে পারে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীল ধরনের কারণে কৃষি উৎপাদন কমতে পারে। এতে কৃষিভিত্তিক পরিবারের ভোগব্যয় নিঃসন্দেহে কমবে। ভেজা ভেজা আবহাওয়া বিভিন্ন সংক্রামক রোগের চারণভূমি, তাই গরম বাড়লে মানুষের অসুখ-বিসুখ বেড়ে যায়। এতে যেমন চিকিৎসার ব্যয় বাড়ে, তেমনি মানুষের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়। অসুখ-বিসুখ না হলেও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়লে মানুষের কর্মসময় ও উৎপাদনশীলতা কমে যায়। আর বাস্তুচ্যুত মানুষেরা নতুন জায়গায় গিয়ে এমন কাজ নিতে বাধ্য হয়, যেটা করার পূর্ব-অভিজ্ঞতা তাদের নেই।
পরিস্থিতি চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে এই সব মানুষের ভোগব্যয় আরও কমবে বলেই অনুমান করা যায়। বাস্তুচ্যুত হলে মানুষের সঞ্চয় ফুরিয়ে যায়। অন্যদিকে আবার গ্রামে বাড়িঘর ঠিক করারও তাগিদ থাকে। এতে তাদের ভোগব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি সন্তানদের পড়াশোনা ও বিকাশ ব্যাহত হবে। এমনিতেই দেশে মৌসুমি দারিদ্র্য বলে একটা ব্যাপার আছে, অর্থাৎ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এই ধারা আরও শক্তিশালী হবে বলেই আশঙ্কা করা যায়।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব দ্বিবিধ। একদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে যাপিত জীবন কষ্টকর হয়, অন্যদিকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। তাপমাত্রা বাড়লে মানুষের চিন্তার সুস্থিরতা থাকে না। বাড়ে অসহিষ্ণুতা, খিটখিটে হয় মেজাজ। অন্যদিকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ে। এতে সামগ্রিকভাবে মানুষের যাপিত জীবন কষ্টকর হয়ে ওঠে, যদি অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা না-ও বলি।
একদিকে গরম বেশি, অন্যদিকে অতিরিক্ত জনঘনত্ব—এই দুই কারণে জীবন এখন হাঁসফাঁস। গণপরিবহনে যাঁরা চলাচল করেন তাঁরা জানেন, সেখানে সামান্য বিষয় নিয়ে কীভাবে যাত্রীর সঙ্গে চালকের সহকারী এবং যাত্রীর সঙ্গে অন্য যাত্রীর কথা–কাটাকাটি বা তর্কাতর্কি হয়। এমনকি সেটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। রাস্তায় রিকশাচালক, সিএনজিচালিত অটোর চালকের সঙ্গে আরোহী, দোকানির সঙ্গে ক্রেতারা সামান্য কারণে রেগে যাচ্ছেন। একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করছেন। এর পেছনে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার প্রভাব আছে বলেই অনেকে মনে করেন।
তবে মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেন, মেজাজ খিটখিটে হওয়ার পেছনে গরম একটা কারণ হতে পারে, তবে এটা অপ্রত্যক্ষ। শৈশবের বিরূপ পরিবেশ, সহিংস আচরণ প্রত্যক্ষ করা, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতি প্রভৃতি নেতিবাচক ঘটনা অনেকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, ফলে অসহিষ্ণু আচরণ, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি গড়ে ওঠে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে অনেক সমীক্ষা করা হয়েছে। এ রকম একটি সমীক্ষায় (হলগটেস ও অন্যান্য, ২০১৭) দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার ভোগ কমবে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, নেপালে ১ দশমিক ৬ শতাংশ ও বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে ভুক্তভোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যদিও এই পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভূমিকা অতি নগণ্য।
সারা পৃথিবী নতুন করে জাতীয়তাবাদে মজলেও জলবায়ু একদম খাঁটি আন্তর্জাতিকতাবাদী। সে কোনো দেশ বা সীমানা মানে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরতে হলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মতৈক্যের বিকল্প নেই। তা না হলে দারিদ্র্যবিমোচনে এত দূর অগ্রসর হওয়ার পর আবার পেছনে যেতে হবে আমাদের। দারিদ্র্যকে হয়তো জাদুঘরে পাঠানো যাবে না। অর্থনীতিতে এবার নোবেল পুরস্কারজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানো বাস্তবে সম্ভব না হলেও এ ধরনের লক্ষ্যের প্রয়োজন আছে। মানুষ চেষ্টা করে কুৎসিত রকমের দারিদ্র্য দূর করতে পেরেছে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সেই অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।
প্রতীক বর্ধন: প্রথম আলোর সহসম্পাদক
bardhanprotik@gmail.com