৬ জানুয়ারি প্রথম আলোর মতামত পাতায় ‘চাকরি নেই, নাকি দক্ষ লোকের অভাব?’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক পাঠক আমাকে ই–মেইলে চিঠি লিখেছেন। অনেকে ফোন করেছিলেন। কর্মসংস্থানের প্রকট ঘাটতি যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় সমস্যা, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু আমার লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় এত বেশিসংখ্যক মানুষ সাড়া দেবেন, এটা আমি ভাবিনি।
ওই নিবন্ধে আমি এক শিল্পপতির কথা লিখেছিলাম, যিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগ করার জন্য পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যোগ্য ও দক্ষ লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি এই বলে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন যে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণ–তরুণীরা ডিগ্রি অর্জনের প্রতি যতটা মনোযোগী, জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা অর্জনের প্রতি ততটা নন। যেসব পাঠক আমাকে চিঠি লিখেছেন, তাঁদের অধিকাংশই শিল্পপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। দেশের বিজ্ঞজনেরাও বলছেন, আমাদের শিক্ষার গুণগত মান ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীরা এ বিষয়টা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করেন, তা বলা কঠিন। তবে দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ আছেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান–বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন।
যেমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আমাকে লিখেছেন, ‘...আমি লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়ি। আমাদের প্রতিটি কোর্স ১০০ নম্বরের। এই ১০০ নম্বরের ২০ নম্বর থাকে টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় আর ৮০ নম্বর থাকে ফাইনাল পরীক্ষায়। ফাইনাল পরীক্ষায় ১০টা প্রশ্নের মধ্যে ৫টা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। পরীক্ষার আগে ১০–১২টা প্রশ্ন পড়ে গেলেই সুন্দরভাবে ৫টা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। পরীক্ষার আগে যে যত ভালোভাবে প্রশ্ন মুখস্থ করে খাতায় উগলে দিতে পারবে, সে তত ভালো রেজাল্ট করবে। তাহলে এখানে আমি কী দক্ষতা অর্জন করব? যেখানে নির্বাচিত কিছু প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে গলাধঃকরণ করে উগলানো হলেই ভালো রেজাল্ট হয়, সেখানে কি দক্ষতা অর্জিত হবে? আর দক্ষতার প্রশিক্ষণটাই–বা দেবেন কে? যাঁরা আমাদের পড়ান, তাঁরাও তো ওইভাবে পড়েই শিক্ষক হয়েছেন। আমাদের ওটাই শিক্ষা দেন: প্রশ্ন মুখস্থ করে খাতায় লেখা। তাহলে আমরা কীভাবে কী দক্ষতা অর্জন করব?’
এই তরুণী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যাটি তুলে ধরেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় তা উগরে দেওয়ার এই ব্যবস্থায় বিদ্যা, জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন করা শুধু অসম্ভবই নয়, বরং এটা প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের প্রতিকূল ব্যবস্থা। আরেক তরুণের চিঠিতে সেই উপলব্ধির দেখা পেলাম। তিনি কয়েক বছর আগে প্রকৌশলশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে নিজেই একটা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...আমার নিজের এবং পরিচিত অনেকের এ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে একজন ছাত্রছাত্রী যখন তার পড়ালেখার বিষয়টি নিয়ে নিজে নিজে বেশ গভীরে যায়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তার পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে। বিষয়টি হয়তো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, কিন্তু কথা সত্য। কারণ, যেসব প্রশ্নের পরীক্ষা হয় সেগুলো বেশ গৎবাঁধা, ঘুরেফিরে একই বা একই ধরনের প্রশ্ন আসে। ওই ধরনের প্রশ্নগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দিলেই ভালো ফল চলে আসে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের “চোথা” পড়ার বিষয়ে আপনি নিশ্চয় জানেন। আবার অনেক সময় শিক্ষকও খুব একটা উৎসাহী থাকেন না যে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা গৎবাঁধা বিষয়ের বাইরে প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলুক। কারণ, তিনি নিজেও তো গঁৎবাধা পড়াই পড়ে এসেছেন। নতুন প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে তাঁকেও যে নতুন নতুন পড়াশোনা করতে হয়। কে এত বেশি কষ্ট করতে চায়, বলুন?...ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে হয় দক্ষ নতুবা সার্টিফিকেটধারী। আমি বলছি না যে সার্টিফিকেটধারীদের মধ্যে দক্ষ মানুষ একেবারেই নেই। আছেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম।’
এটা একটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয় যে দেশের শ্রমবাজারে দেশি দক্ষ কর্মী পেতে হলে আগে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। কিন্তু কোথায় দক্ষ কর্মী তৈরি হবে? কারা তৈরি করবেন? দায়িত্বটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এবং শিক্ষকদের। কিন্তু ওপরে উল্লিখিত দুই তরুণ–তরুণীর বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ কর্মী তৈরির অনুকূল ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থাটা পরীক্ষামুখী, ফলমুখী, সনদমুখী—জ্ঞানমুখী নয়। ১০–১২টা প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ৫টা প্রশ্ন উগরে দিয়ে ‘ভালো ফল’ করার এই ব্যবস্থায় দক্ষ কর্মী তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার এই মৌলিক সমস্যাটির সমাধান কী? সংক্ষেপে উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, এ কথা বলে তিনি বললেন, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছার আগের প্রতিটি ধাপে শিক্ষাদান, শিক্ষা গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ইত্যাদির প্রচলিত পদ্ধতি আরও উন্নত করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার গুণগত মান অর্জিত না হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ঘাটতি থেকে যায়। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নপদ্ধতি এমন হওয়া উচিত, যাতে তারা শুধু প্রশ্ন মুখস্থ করেই ভালো ফল না করতে পারে, বরং প্রতিটি বিষয় পর্যাপ্তভাবে আত্মস্থ সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়। শিক্ষা কঠোর অধ্যবসায় ও অনুশীলনের বিষয়; কিন্তু আমাদের দেশে তা সহজ হয়ে গেছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বললেন, আমাদের দেশে চাকরিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততার অভাব আছে। স্বজনপ্রীতি, তদবির, টাকাপয়সার লেনদেনের বিষয় আছে। এগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীরা তখনই ভালোভাবে পড়াশোনা করে যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করবে, যখন নিশ্চিত হবে যে তাদের যোগ্যতা ন্যায্যভাবে মূল্যায়িত হবে।
আমাকে যেসব পাঠক চিঠি লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে শুধু যোগ্যতা থাকলেই চাকরি পাওয়া যায় না, প্রভাবশালী মামা–চাচা থাকতে হয়। ‘রেফারেন্স’ ছাড়া চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে চাকরিদাতারা চাকরিপ্রার্থীর যোগ্যতা–দক্ষতা আছে কি নেই, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেন না। তাঁর অভিযোগ, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের চাকরির ইন্টারভিউ লোক দেখানো ব্যাপার।
এক প্রবাসী পাঠক লিখেছেন, ‘অনেক বছর আগে আমি ইউরোপ থেকে বিএ ও এমএ ডিগ্রি সম্পন্ন করে বাংলাদেশে ফিরে যাই। আমি ইংরেজিতে সাবলীল, আমার আইএলটিএস স্কোর ছিল ৭। আমি একটা চাকরি পেয়েছিলাম, আমার বেতন ছিল সাড়ে ১৬ হাজার টাকা। ওই একই প্রতিষ্ঠানে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা এক ব্যক্তি আরও বেশি বেতনে চাকরি করছিলেন; তাঁকে বেশি বেতন দেওয়া হচ্ছিল কারণ তিনি কর্তৃপক্ষের তোষামোদি করতেন। শেষে আমি ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসি। এখন আমি অন্য একটি দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে আসতে পারায় আমি খুব খুশি। বাংলাদেশে যোগ্য গ্র্যাজুয়েটরা যদি তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পান, তাহলে তাঁরা দেশে থাকবেন না, বিদেশে চলে যাবেন।’
আর এক পাঠক অভিযোগ করেছেন, আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশি কর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো বেতন দেয় না, কিন্তু বিদেশিদের দেয়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন, ‘ঠিকই তো, বিদেশ থেকে লোক নিয়ে আসেন। যে টাকায় নিয়ে আসেন, সেই টাকা দেশের একজন যোগ্য কর্মীকে দিতে আপনাদের আপত্তি, দেশি যোগ্য কর্মী পেলে তঁাকে বেতন দেবেন বিদেশিদের চেয়ে অর্ধেকেরও কম!’
আমি একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী, ২০১৪ সালে বিএসসি করেছি। ছাত্রজীবনে একটা মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসেবায় শিক্ষানবিশ কর্মী ছিলাম প্রায় দুই বছর। পড়া শেষে সাত মাস ইন্টার্ন করলাম আরেকটা মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল বিভাগে। তারপরও কোথাও চাকরি পেলাম না। ১২ জন মিলে ব্যবসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু রাজনীতিবিদদের উদার পরিচালনায় দেশে তখন চলছে টানা তিন-চার মাস অবরোধ! উঠতি উদ্যোক্তাদের অবস্থা কী হয়, বোঝেন! তারপর ২০১৬ সালে এমএস করলাম, চাকরির জন্য অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম; বেতন দিতে চায় ১২ হাজার, সাড়ে ১৩ হাজার। এই হলো অবস্থা—টানা দুই বছর বেকার! শেষে দেশই ছাড়লাম। এখন ইকুয়াটোরিয়াল গিনি নামের এক দেশে নেটওয়ার্ক অ্যান্ড সিস্টেম অ্যাডমিনে কাজ করছি ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার বেতনে। এখন বিচার করেন আপনারাই!’
বাংলাদেশে দক্ষ কর্মী একদমই নেই, এটা সত্য নয়। বড় ডিগ্রিধারী বা পরীক্ষায় ভালো ফলের অধিকারী হলেই যে কেউ জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু চাকরিদাতারা ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এর একটা সমাধান হিসেবে এক পাঠক প্রস্তাব করেছেন, ‘চাকরিতে নিয়োগের বিজ্ঞাপনে প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্দিষ্ট ডিগ্রিধারী না হলে চাকরির আবেদন করাই সম্ভব হয় না। তাই অতি স্বল্পসংখ্যক দক্ষ সার্টিফিকেটধারীকে খুঁজে পাওয়া অনেকটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো হয়। এ ক্ষেত্রে যদি ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা কিছুটা হলেও শিথিল করা হয় এবং ইন্টারভিউ বোর্ডেই প্রার্থীদের যোগ্যতা–দক্ষতা যাচাই করে নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো তাঁরা কিছু যোগ্য কর্মী খুঁজে পাবেন। এই সংস্কৃতি চালু হলে শিক্ষার্থীরাও শুধু সনদের পেছনে ছোটা কমিয়ে প্রকৃত বিদ্যা, জ্ঞান, দক্ষতা অর্জনের প্রতি আরও মনোযোগী হবে।’
আরও পড়ুন:
চাকরি নেই, না দক্ষ লোকের অভাব?
মশিউল আলম, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
mashiul.alam@gmail.com