এটা পুরোনো খবর যে উত্তর প্রদেশে এলাহাবাদের নাম পাল্টে হয়েছে প্রয়াগরাজ। একের পর এক বিখ্যাত শহরগুলোর নাম পাল্টে দেওয়া হচ্ছে ভারতে। আহমেদাবাদের নাম কর্ণাবর্তী করার উদ্যোগ চলছে। বিজেপি সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন কাগজপত্রে এটাকে কর্ণাবতী হিসেবেই লিখছে। শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের নাম পাল্টে করা হবে ভোজপাল। এসব নিয়ে ভারতজুড়ে হইচই হচ্ছে এখন। তার ঢেউ লেগেছে ঢাকার প্রচারমাধ্যমেও।
সন্দেহ নেই যে নাম পরিবর্তনের এসব আয়োজন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। ভারতে আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে এসব নাম পাল্টানোর গভীর যোগ আছে। সংগত কারণেই বিজেপির নিন্দা হচ্ছে। কিন্তু বিতর্ককালে আমরা ভুলে যাচ্ছি, ঢাকা ও বাংলাদেশের আনাচকানাচেও একই রাজনীতি কম হয়নি।
পুরান ঢাকার হাটখোলা এলাকার শের-ই-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল নারী শিক্ষা মন্দির। যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লীলা নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই ছাত্রীর একজন ছিলেন লীলা নাগ (অন্যজন ছিলেন সুষমা সেনগুপ্ত)। তাঁর স্বামী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী অনিল রায়। ইতিহাসে এরূপ তথ্যও রয়েছে যে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী ছিলেন লীলা নাগ। ১৯৭০-এ মারা যান তিনি। পরের বছরই লীলা নাগের গড়া বিদ্যালয়টির নাম পাল্টে আমরা করেছি ‘শের-ই-বাংলা বালিকা বিদ্যালয়’।
এ কে ফজলুল হক বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক বড় মাপের চরিত্র যে তাঁর নামে একটা স্কুলের নাম না পাল্টালেও চলত। কিন্তু সেটাই করা হয়েছে। রাজনৈতিক ভক্তিবাদ অনেক সময়ই অন্ধ। কখনো কখনো হাস্যকরও।
ভারতে গত জুনে বিখ্যাত মোগলসরাই রেলস্টেশনের নাম পাল্টে করা হয় দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন। দীনদয়াল চরম দক্ষিণপন্থী একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা। তাঁর নামে রেলস্টেশনটির নাম করার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়, এই স্টেশনের কাছে তিনি মারা গিয়েছিলেন!
পাকিস্তানেও এ রকম কাণ্ড কম হয়নি। পাঞ্জাবের দ্বিতীয় জনবহুল শহর লয়ালপুর মূলত ব্রিটিশ শাসকদের একটা অবকাঠামোগত কীর্তি। পাঞ্জাবের গভর্নর জেমস লয়ালের নামে ১৯০৪ থেকে এই শহর গড়ে তোলা হয়। যাকে বলা হতো পাকিস্তানের ম্যানচেস্টার। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তান সরকার হঠাৎ জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে। শহরটির নাম পাল্টে রাখা হয় ফয়সালাবাদ। যাঁর নামে এই নামকরণ, তিনি পাকিস্তানের কেউ নন। তিনি ১৯৭৫ সালে প্রয়াত সৌদি আরবের সাবেক বাদশা। লয়ালপুরের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনো সম্পর্ক ছিল না।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড থেকে বাংলা ও আসামের গভর্নর বামফিল্ড ফুলারের নাম এখনো বাদ দেননি। কিন্তু কিছুটা দূরের মদন মোহন বসাক লেনের নাম পাল্টে করা হয়েছে টিপু সুলতান রোড। দীপালি স্কুলের নাম পাল্টে করা হয়েছে কামরুন্নেসা বিদ্যালয়।
ঢাকা শহরে এ রকম উদাহরণ আছে অসংখ্য। ঢাকার বাইরেও অনেক। স্বরূপকাঠি কীভাবে নেছারাবাদ এবং জয়দেবপুর কীভাবে গাজীপুর, সেটা হয়তো আগামী প্রজন্ম জানতেই পারবে না।
দুই.
উপমহাদেশজুড়ে নাম পাল্টানোর যে হিড়িক পড়েছে, অনেকেই তাকে রাজনৈতিক ছেলেমানুষি মনে করেন। কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে এটা ভয়ংকর ও বিধ্বংসী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা এলাকার আদি নামকরণের পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস; আছে অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক বা সামাজিক বিবিধ কারণ। আমলাতান্ত্রিক ফরমানে এক ঘোষণায় সেই ইতিহাস ও সংস্কৃতি মুছে দেওয়া দস্যুতার মতোই। ফলে, অনেক সময়ই নাগরিকেরা নতুন নাম ব্যবহার করতেও আগ্রহী হন না। ঢাকায় এলিফ্যান্ট রোড এখনো সুপরিচিত, যদিও বহু আগেই এর পুনর্নামকরণ হয়েছিল। ধানমন্ডির একটি বিখ্যাত সড়কের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
অনেক ক্ষেত্রেই পছন্দনীয় কোনো ব্যক্তিকে ইতিহাসে দীর্ঘায়ু দিতে কিংবা কারও আয়ু কমাতে নাম উৎপাটন ও পুনর্লিখন করা হয়। আবার কোথাও হিন্দুত্ব, কোথাও মুসলমানত্ব, কোথাওবা বৌদ্ধত্বকে মহিমান্বিত করতে নাম পাল্টানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দরটির নাম ইতিমধ্যে কয়েক দফা পাল্টেছে। ১৯৯০–পূর্ব সময়ে জেলাগুলোর নামের বানানে অনেক ঘষামাজা হয়। সম্প্রতি আবারও অনুরূপ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বিগত এক ‘নগরপিতা’র আমলে অন্তত ৬৭টি সড়কের নতুন নামকরণ হয়। ছোটখাটো একটা রেকর্ড বলতে হবে একে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ওই নগরপিতা নিজের নামেও একটি সড়কের নামকরণ করেছিলেন তখন।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই এসব চিরজীবন্ত এক প্রবণতা। একজন লেখক তাই কৌতুক করে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে একটি করে ‘নাম ও বানানবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ থাকা উচিত।
যদিও দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশই রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রবলভাবেই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বরাবরই ‘স্বাধীনতা’র যুক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিগত কয়েক দশকে নামধাম থেকে ঔপনিবেশিক চিহ্ন মুছতে সবচেয়ে তৎপর শ্রীলঙ্কা। প্রথমে তারা দেশের নাম ‘সিলন’ থেকে শ্রীলঙ্কা করেছে। কিন্তু ‘ব্যাংক অব সিলন’, ‘সিলন পেট্টোলিয়াম করপোরেশন’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগের নামেই চলছে। ব্যবসায়ের ক্ষতি হবে ভেবে আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো ‘সিলন টি’ নামও চালু আছে। এসব স্ববিরোধিতা নিয়ে দেশটিতে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, এমন দেখা যায়নি।
তিন.
নাম পরিবর্তনের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ক্ষমতা প্রদর্শনের নীরব অভিলাষও যুক্ত থাকে। মিয়ানমারে ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে রেঙ্গুনের রাজপথে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা শেষে ক্ষমতায় এসেছিলেন জেনারেল শ মং। পরের বছর তিনি দেশটির নাম পাল্টান। সঙ্গে রাজধানীর নামও। সেই থেকে বার্মা হয়েছে মিয়ানমার; রেঙ্গুন হয়েছে ইয়াঙ্গুন। শ মংয়ের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারই ১৯৯০-এ নির্বাচনী বিজয় হওয়া সত্ত্বেও অং সান সু চিকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। শ মং সরকারের হাতেই আরাকানের নাম হয় রাখাইন; আকিয়াবের নাম হয় সিত্তিউই। এই জনপদের শত শত বছরের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ ছিল এগুলো এবং তা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায় না। বার্মার জেনারেলদের নাম বদল প্রকল্পের রক্তাক্ত শেষাংশ দেখা গেল ২০১৭-এর আগস্টে নাফের দুই পাড়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও দেশান্তরের মাধ্যমে।
পাকিস্তানেও বিভিন্ন সড়ক ও শহরগুলোর নাম পরিবর্তনের বিশেষ হিড়িক পড়েছিল তাদের চার তারকা জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বেশ হাস্যকরভাবেই করা হয়েছে। যেমন করাচিতে ১৯৭৭ পর্যন্ত একটি সড়কের নাম ছিল ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মতিলাল নেহরুর নামে। সম্ভবত ভারতীয় এবং হিন্দু বলে পরবর্তীকালে সড়কটির নাম করা হয় কবি জিগর মুরাদাবাদির নামে। জিগর মুসলমান হলেও তাঁরও বাড়ি ভারত ভূমিতেই পড়েছে। পুরোনো ও নতুন নামের ধর্মীয় বিবেচনার দিকে অধিক মনোযোগী করাচির স্থানীয় শাসকেরা এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক দিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখেননি বলে মনে হয়েছে!
নাম পরিবর্তনে অতি সংকীর্ণ ধর্মীয় বিবেচনা এখন বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে ভারতে বিজেপি শাসকদের কাছে। অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে এটা তাদের কেন্দ্রীয় এক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।
হিমাচলের রাজধানী সিমলা এত সুন্দর একটা জায়গা ছিল যে গ্রীষ্মকাল এলেই ব্রিটিশরা প্রথমে কলকাতা এবং পরে দিল্লি থেকে দপ্তর সরিয়ে নিত সেখানে। কিন্তু ১৫৪ বছরের পুরোনো সিমলায় এখন বহু সমস্যার পাশাপাশি সুপেয় পানির তীব্র সংকট। রাজ্যের বিজেপিদলীয় শাসকদের সেদিকে মনোযোগ নেই। তাঁরা কর্মসূচি নিয়েছেন সিমলার নাম পাল্টে ‘শায়মালা’ করা হবে। বিজেপির মিত্র বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বলছে, শায়মালা দেবীর নামেই অতীতে নাকি এই শহরটির পরিচিতি ছিল।
বিজেপিপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবী ভারতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যুক্তি তুলে ধরছেন, কীভাবে এসব নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ থেকে মুক্ত হবে ভারত-আত্মা।
বার্মা থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত সর্বত্রই নাম পরিবর্তনের পেছনে এসব তথাকথিত র্যাডিক্যাল যুক্তি তুলে ধরা হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ যে তাদের আইন-আদালত-প্রশাসনে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকে প্রায় সম্পূর্ণ সংরক্ষণ করে রেখেছে, সেসব খাত সংস্কারের বিষয়ে উপরিউক্ত র্যাডিক্যাল তাত্ত্বিকেরা একেবারে নীরব। মনে হচ্ছে, ন্যায়বিচারের ঐতিহাসিক আরজি এবং জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা এ মুহূর্তে কেবল নাম ও বানানের মাঝেই তার মুক্তি দেখছে।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক