দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজার যে কারণে অস্থির হচ্ছে

মালয়েশিয়ার পাম খামারে কর্মরত বিদেশি শ্রমিক
 ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ সারা বিশ্বের শ্রমবাজারকে অস্থির করে ফেলেছে। এতে বৈশ্বিক জনশক্তির সংকট তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লি ও ঢাকার মতো বড় বড় শহর থেকে কাজ হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বংশোদ্ভূত শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (আসিয়ানভুক্ত) দেশগুলোতেও শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছে। হো চি মিন সিটির ওপর থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর শহর থেকে রেকর্ড সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক বেরিয়ে গেছে। ফলে সেখানে শ্রমবাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

উচ্চ আয়ের কিছু দেশ এশিয়ার শ্রমিকদের আবার কাজে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো আসিয়ানভুক্ত কিছু দেশ এখন বিদেশি দক্ষ শ্রমিক ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। কেননা তাঁদের মজুরি দেওয়া চাকরিদাতাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর কৃষিশ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ ভিসা স্কিম ঘোষণা করায় অনেক দেশ, বিশেষ করে মালয়েশিয়া বড় ধরনের চিন্তায় পড়ে গেছে। এ স্কিমের আওতায় অস্ট্রেলিয়ার জনশক্তি আমদানিকারকেরা এশিয়া থেকে দক্ষ, আধা দক্ষ এবং সম্পূর্ণ অদক্ষ শ্রমিক দীর্ঘ মেয়াদে আনতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে শ্রমিক সুরক্ষার মান বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার শ্রমিকেরা অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করতে যেতে আগ্রহী হবেন। প্রথম দফায় এশিয়া থেকে আগামী মাসেই অস্ট্রেলিয়ায় শ্রমিকেরা যাবেন। দ্বিতীয় দফায় যাবেন আগামী বছরের মার্চে।

মালয়েশিয়ার নতুন নির্বাচিত সরকার প্রাথমিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার এ স্কিমে যোগ দিতে রাজি হয়নি। তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচনা হয়। বিরোধী দলগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি জানানোর পর সরকারের তরফে জানানো হয় মালয়েশিয়ার কোনো শ্রমিক যদি বিদেশে চাকরি করতে যেতে চান, তাহলে তারা তাতে বাধা দেবে না। অস্ট্রেলিয়ার এ ভিসা প্রকল্পে মালয়েশিয়ার দুশ্চিন্তায় পড়ার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, মালয়েশিয়ার নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এতে মালয়েশিয়ার শ্রম খাত মেধাসংকটে পড়ে যাবে। কারণ, এমনিতেই মালয়েশিয়ার ২০ লাখের বেশি শ্রমিক বিদেশে কাজ করছেন। এই ২০ লাখের একটা বড় অংশ কাজ করছেন প্রতিবেশী দেশ সিঙ্গাপুরে। যেহেতু অস্ট্রেলিয়া এখন আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর শ্রমিকদের স্থায়ী বসবাসের অনুমতি ও নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছে, সে কারণে মালয়েশিয়া তার কৃষিশ্রমিকদের একটি বড় অংশ হারানোর চিন্তায় পড়ে গেছে।

কোভিড-১৯ সারা বিশ্বের শ্রমবাজারকে অস্থির করে ফেলেছে। এতে বৈশ্বিক জনশক্তির সংকট তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লি ও ঢাকার মতো বড় বড় শহর থেকে কাজ হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বংশোদ্ভূত শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯–এর কারণে মালয়েশিয়ায় অদক্ষ শ্রমিক আমদানি কমানোর জন্য দেশটিতে রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। স্থানীয় নাগরিকেরা বিদেশি অদক্ষ শ্রমিক ঢুকতে দিতে চাইছেন না। অথচ অস্ট্রেলিয়া সরকার আসিয়ানভুক্ত দেশের দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে। সর্বশেষ দিক হলো, মালয়েশিয়ার খামারিরা দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছেন। তরুণ প্রজন্মের খামারিরা বিদ্যমান মজুরিতে এ খাতে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার আকর্ষণীয় বেতনে এ খাতে কাজ করতে রাজি আছেন। এতে মালয়েশিয়া চাপে পড়েছে।

মালয়েশিয়ার মতোই আসিয়ানভুক্ত অন্য উচ্চ আয়ের দেশগুলোর অবস্থা। এ অঞ্চলের দেশগুলোর শ্রমিকদের অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করতে যাওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া এবার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে বিদেশি শ্রমিকদের সম্পূর্ণ অধিকার ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এটি মালয়েশিয়ান শ্রমিকদের অস্ট্রেলিয়ায় যেতে আগ্রহী করছে। এই শ্রমিকেরা চলে গেলে শ্রমিকশূন্যতা তৈরি হবে—এটি মাথায় রেখেই মালয়েশিয়া সরকার নতুন করে বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ থেকে কৃষিশ্রমিক নেবে। তাঁরা শিগগিরই দেশটির বিভিন্ন খামারে যোগ দেবেন বলে সরকার জানিয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার জন্য বড় সমস্যা হলো, দেশটি থেকে যে দক্ষ শ্রমিকেরা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবেন, তা পূরণ করা তার জন্য সংকটে পড়তে হবে। এ সমস্যা শুধু মালয়েশিয়ার জন্য নয়, আসিয়ানভুক্ত অন্য সচ্ছল দেশকেও প্রভাবিত করেছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি অব মালয়-এর উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক