বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট পুরুষ দলের পেসার রুবেল হোসেনের একটি ফেসবুক মন্তব্য ভাইরাল হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ নিয়ে তিনি নিজের মতামত দিয়েছেন। করোনার ত্রাণ নিয়ে সারা দেশে একরকম হরিলুট চলছে। বিভিন্ন জায়গায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালসহ আটক হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা–কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা। ঘরের মেঝে, পুকুর, ডোবা, গুদাম ঘর থেকে ত্রাণের চাল উদ্ধার হচ্ছে। আর ত্রাণ না পেয়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করছেন আনুষ্ঠানিকভাবে অঘোষিত লকডাউনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ। রুবেল প্রশ্ন করেছেন, ঘরে ঘরে যদি ভোটার লিস্ট পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া যাবে না কেন?
রুবেলের এই প্রশ্নটি কিছুটা বেখাপ্পা মনে হতে পারে। ঘরে ঘরে কি ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব? এই সময়ে এসে এটা কোন ধরনের প্রস্তাব। কিন্তু রুবেল প্রকারান্তরে আমাদের ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন। কারণ, এ নিয়ে কেউ তেমন কথা বলছেন না। সমাজের যে অগ্রসর, জ্ঞানী–গুণী, বিদগ্ধ অংশের এই প্রশ্ন করার কথা, তাঁদের অনেকেই মুখে খিল এঁটে বসে আছেন। হয়তো সময়কে মেনে নিয়েছেন। বা রুবেলের মতো প্রশ্ন করার সাহস অর্জন করতে পারেননি। বাস্তবতা হচ্ছে, সময় তো কারও জন্য অপেক্ষা করে না। তাই ভয়, রুবেল আচমকা প্রশ্নটি করে বসলেন। তিনি যদি বেমক্কা এক বাউন্সার ছুড়ে দেন সরকারি কর্তাব্যক্তিদের প্রতি, তবে নিপুণ এক ইয়র্কার দিলেন লুটেরা শ্রেণির অবস্থানের দিকেও। রুবেল আসলে সবাইকে লজ্জায় ফেলে দিলেন। কারণ, রুবেলের এই প্রশ্নটি করার কথা না।
ত্রাণ বিতরণের অনিয়ম হয়তো রুবেলকে নাড়া দিয়েছে। রুবেল প্রকৃতপক্ষে ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থাপনার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোয় দেখা যাচ্ছে, করোনার সংকট মোকাবিলায় সরকারের তরফ থেকে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ চলছে। কিন্তু দরিদ্ররা সঠিকভাবে ত্রাণ পাচ্ছে না। বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণের ব্যাপারে বিক্ষোভ হয়েছে। লকডাউন ভেঙে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে মিছিল করেছে। রংপুরে সদ্য প্রয়াত সামরিক শাসক এরশাদের বাড়ি ঘেরাও করেছে ভুখা লোকজন।
শুধু বিক্ষোভ প্রতিবাদেই থেমে নেই পরিস্থিতি; সিরাজগঞ্জে দশ বছরের শিশু আফরোজা খাদ্যের অভাবজনিত কারণে আত্মঘাতী হয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের নানা কথা আমরা শুনছি, কিন্তু দুর্যোগের সময় আফরোজার ভাতের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই একরাশ অভিমান নিয়েই চলে গেল সে।
ওদিকে জামালপুরে ক্ষুধার্ত কর্মহীন জনতা ট্রাক আটকে চাল ও আলু ছিনিয়ে নিয়েছেন। ত্রাণের ট্রাক লুট বা আফরোজার আত্মহত্যা খুব ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিরতা ভেঙে পড়ার নিশানা থাকে এসব ঘটনায়। সমাজের এই পরিবর্তনের আঁচ টের পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘটনায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নাগরিক ও রাষ্ট্রকে একটি আস্থার জায়গার উপনীত হতে হবে। নতুবা রাষ্ট্রের জমিন বা ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
ত্রাণের ট্রাক লুটে নেওয়ারা অভিযোগ করছেন, তাঁরা কয়েক দিন ধরে খেতে পারেননি। জনপ্রতিনিধিদের কাছে ত্রাণের জন্য গেলে তাঁদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ত্রাণের চাল বেশ কজন জনপ্রতিনিধি কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বারবার ধরনা দিয়েও ত্রাণ মেলেনি। তাই নিরুপায় হয়ে জামালপুরের লোকজন ত্রাণের ট্রাক লুটে নিয়েছেন। ওদিকে ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ করা কুড়িগ্রামে দুই ভাইকে আটক করেছে পুলিশ। তার মানে, একদিকে ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না, আবার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই জেল–জুলুমের শিকার হচ্ছেন অভুক্তরা।
কিন্তু আমাদের তো খাদ্যসংকট থাকার কথা না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এরপরও ত্রাণের জন্য এত হাহাকার কেন? অঘোষিত লকডাউনের কারণে মূলত শ্রমজীবী মানুষ যাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের কাছে খাবার ক্রয়ের মতো অর্থ নেই। তাঁরাই ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। নারায়ণগঞ্জের একজন জনপ্রতিনিধি বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, পাঁচ হাজার মানুষের তালিকা দিয়ে অল্প ত্রাণ পেয়েছেন। আরেকজন জানিয়েছেন, তিনি যে পরিমাণ ত্রাণ পেয়েছেন, তাতে ২০০ জনকে দেওয়া সম্ভব। অথচ তাঁর কাছে তিন হাজার মানুষ ত্রাণ চেয়ে বসে আছে।
অনেক জায়গাতেই এই অপ্রতুল ত্রাণ আবার আত্মসাৎ করে ফেলছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিদিনই জনপ্রতিনিধিদের আটক করা হচ্ছে বা তাঁদের কাছ থেকে চাল উদ্ধার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান ও ধরপাকড়ের পরও ত্রাণচোরদের কোনোভাবেই সংযত করা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মাঠপর্যায়ের তথ্য হচ্ছে, কমসংখ্যক আত্মসাৎকারীকেই আটক করা যাচ্ছে। বেশির ভাগ আত্মসাৎকারীর খুঁটির জোর এত বেশি যে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এক ত্রাণচোরকে সহায়তা করার জন্য সংসদ সদস্য পর্যন্ত আদালতে গিয়েছেন। সুতরাং ত্রাণচোরদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। কেউ কেউ সরকারি দলের লোক। শুধু ত্রাণই আত্মসাৎ হচ্ছে না; ১০ টাকা কেজি চালের সহায়তা কার্ড দেওয়ার বিনিময়ে ৫০০ টাকা করে ঘুষও নিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমন অভিযোগও এসেছে।
এসব অভিজ্ঞতা বলছে, আমাদের ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। ত্রাণ চুরি সব সরকারের আমলেই হয়েছে। কখনো বেশি হয়, কখনো কম হয়। তাই আমাদের ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি। দেশ এখন এগিয়েছে। প্রযুক্তির যুগ চলছে। এখনো কেন জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে হাতে হাতে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ত্রাণ বিতরণ করা যেতে পারে।
ভোটার তালিকা ধরে ধরে গরিবদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা যেতে পারে। অথবা সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদের সরাসরি আর্থিক সহায়তা করতে পারে রাষ্ট্র। যেকোনো দুর্যোগ বা ক্রান্তিকালের সরাসরি দরিদ্রদের ব্যাংক হিসাবে সহায়তার অর্থ চলে যাবে। তাহলে আর ত্রাণ চুরির সুযোগ থাকবে না। এই চাল, ডাল, আলু বিতরণের দিন এখন আর নেই। বরং জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে যত দিন ত্রাণ বিতরণ করা হবে, তত দিন চুরি ঠেকানো সম্ভব না। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক হিসাব–নিকাশ থাকে। মনোনয়ন বেচাকেনা হয়। তাই সরকারের পক্ষে জনপ্রতিনিধিদের ওপর খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করাও সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা সরাসরি ব্যাংকে প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। সাহায্যপ্রাপ্তরা ডিলার বা টিসিবির দোকান থেকে কমমূল্যে পণ্য ক্রয় করবেন। চাইলে তাঁরা সাধারণ বাজার থেকেও খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারবেন। এতে করে ত্রাণ চুরির পথ রোধ হবে।
আরেকটি কথা, ত্রাণ বিতরণ যেন অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে করা হয়। লাইন ধরে ত্রাণ বিতরণের দিন এখন আর নেই। যাঁরা ত্রাণ নিচ্ছেন, তাঁরা রাষ্ট্র থেকে কোনো ভিক্ষা গ্রহণ করছেন না বা উপহারও নিচ্ছেন না। বরং এটা তার অধিকার। রাষ্ট্র কেবল নাগরিকের অধিকার বাস্তবায়নের নিমিত্তে কাজ করে। আর সরকার রাষ্ট্রের সেই কাজ সম্পাদন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। ত্রাণ জনপ্রতিনিধির নয়ছয় আর দলীয় কর্মীদের বখরার ভাগ নয়, জনগণের ন্যায্য পাওনা।
ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক