কিছু কিছু মানুষকে হারানোর বেদনা, তার তীব্রতা যেন একটুও কমতে চায় না—সেই মানুষটি কাছেরই হোক বা দূরের, আত্মীয় বা অনাত্মীয়—তা যত পুরোনোই হোক না কেন, বিশেষ করে মানুষটি যদি হয় একটি নিষ্পাপ শিশু, যাকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে; বরং যত দিন যায়, সেই ব্যথার সঙ্গে হতাশা আর ক্ষোভ মিলেমিশে যন্ত্রণার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশেষত, যেহেতু হারানোর ঘটনাটি ঘটেনি কোনো স্বাভাবিক জৈবিক কারণে বা স্বাভাবিক নিয়মে। ঘটনাটি ঘটেছে কিছু দুর্বৃত্তের অপরাধপ্রবণতার কারণে। চিহ্নিত খুনিরা অপহরণ করে নৃশংসভাবে একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছে, কিন্তু সমাজের বিচারহীনতার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে তারা এখনো দাপটের সঙ্গে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শোকের কষ্ট শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এর বিচার না হওয়ার অনাচার। তাই আজ সাত বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ত্বকীর হত্যাকাণ্ডের বেদনা একটুও ম্লান হয়ে যায়নি।
ত্বকীকে আমি কখনো দেখিনি। ওকে জানতে শুরু করেছি ওর চলে যাওয়ার পরে। আর যত জানছি, ততই অবাক হয়েছি, ওকে হারানোর বেদনা ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। আজ ত্বকীর চলে যাওয়ার দিনে ওকে স্মরণ করছি গভীর বেদনায়, পরম মমতায়।
আমার পেশাগত কারণে ত্বকীর বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। ত্বকীর সঙ্গে তেমনভাবে কোনো কারণে একসঙ্গে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। ওকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনারও সুযোগ হয়নি, যদিও ওর বাবা রফিউর রাব্বিকে পেয়েছি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সহকর্মী হিসেবে। তবে তাঁর লেখা পড়ে, কথা শুনে, অন্যের মুখে তাঁর জীবনধারা সম্পর্কে জেনে তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক গভীর হয়েছে। ত্বকীর মৃত্যুতে আমি পরিবারের সদস্য হারানোর বেদনায় আক্রান্ত বোধ করেছি। ত্বকীর ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, শিউরে উঠেছি এই ভেবে যে, আহারে, একটা শিশুকে কী যন্ত্রণাটাই না সহ্য করতে হয়েছে। সে নির্যাতন যেন ত্বকীর শরীর ছাপিয়ে আমাদের সবাইকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমরা ত্বকীকে রক্ষা করতে পারিনি। এখনো পারছি না ত্বকীদের রক্ষা করতে এই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে—মূলত অপরাধের জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি বলে, পারি না বলে। এ ব্যর্থতায় লজ্জাবোধ করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি বলে প্রায়ই যাঁদের কোনো না কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, অথচ সেই অধিকার লঙ্ঘনের কোনো বিচার পাচ্ছেন না, তাঁদের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। বিচার না পাওয়া লোকজনের দুঃখ–ক্ষোভ অনেক গুণ বেড়ে যায়, যখন তাঁরা দেখেন যে এর পেছনে রয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসনের অনীহা, অবহেলা—এমনকি কখনো কখনো আপাতসম্মানিত প্রভাবশালী নেতাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ। ত্বকী হত্যার বিচারের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। কারণ, এ হত্যাকাণ্ডের বছর না যেতেই তদন্তকারী সংস্থা সংবাদ সম্মেলন করে এ হত্যার রহস্য উন্মোচনের দাবি করেছিল। তারা হত্যার কারণ, স্থান, সময়সহ ঘাতকদের নাম-পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করেছিল। অথচ অভিযোগপত্র আদালত পর্যন্ত গড়াল না।
যাঁরা ত্বকীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাঁরা সবাই প্রথম দিন থেকেই দেখে আসছেন যে যথেষ্ট দৃশ্যমান লক্ষণ থাকার পরেও ত্বকীর হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার কাজটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর; বরং এই বিষয়ে যতটা পারা যায় সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এখন এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে একেবারেই স্থবির করে ফেলা হয়েছে।
সাত বছর অতিক্রান্ত হলো, ত্বকী হত্যার বিচারকার্য এখন আশ্চর্যজনকভাবে থেমে আছে, এক বিন্দুও এগোচ্ছে না, এখন পুরোপুরি থমকে আছে। অথচ আমাদের দেশের পুলিশের ক্ষমতা, তৎপরতা ও দক্ষতা সম্পর্কে আমরা সম্যক অবগত আছি। আর তাই তাদের এহেন অপারগতা ত্বকী হত্যা মামলা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। মামলাটি আমাদের সমাজের বিচারহীনতার একটি বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে। আমরা এ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই, ত্বকী হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে সমাজের ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই।
সুলতানা কামাল আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী