ত্বকী হত্যা: দুর্বৃত্ততোষণ ও বিচারহীনতার ব্যাকরণ

কোনো কোনো ঘটনা বা কোনো কোনো মুখ মানুষকে আচ্ছন্ন জীবন থেকে মুক্ত করে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড় করায়। বইপড়া, লেখালেখি আর শিল্পকর্মে ডুবে থাকা এক কিশোর, নাম যার তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে খুন করা, বছরের পর বছর খুনের বিচার আটকে থাকা এবং খুনিদের আস্ফালন—সব আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এ রকম একটি মুখ, এ রকম একটি দুঃস্বপ্ন আমাদের অবিরাম যন্ত্রণা দিতে থাকে, প্রশ্নের ভার তৈরি হয়। একটি মুখই তাড়া দিতে থাকে, নীরবতা ভেঙে আরও বহু রক্তাক্ত মুখ স্মরণ করতে, নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে।

প্রতিবছর যখন এই দিন আসে (২০১৩ সালের ৬ মার্চ, ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার দিন), তত দিনে ত্বকীর সঙ্গে যোগ হয় আরও নাম, খুন-গুম-জুলুমের মধ্যে থেকে তাদের কণ্ঠস্বর ভাসে। এই সারিতে আগে থেকেই আছে সাগর-রুনির নাম—ছোট সন্তানের মা–বাবা সাংবাদিক দম্পতি। ঘরে এসে খুনিরা তাদের খুন করে গেছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিলেও রাষ্ট্র এত বছরেও তার তদন্ত শেষ করেনি। সোহাগী জাহান ওরফে তনু নামের এক তরুণী সাংস্কৃতিক কর্মীকে ধর্ষণের পর খুন করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। না, এত বছরেও সে বিষয়ে কোনো তদন্ত এগোয়নি। আর নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে প্রবল প্রতিবাদের কারণে ত্বকী হত্যার তদন্ত হয়েছিল, খুনি শনাক্তও হয়েছিল, তাদের মধ্যে আজমেরী ওসমানের নাম ছিল প্রথমে। তারপরও ওপরের নির্দেশে আর বিচার এগোয়নি। উল্টো এই পরিবারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আরও পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে সরকার। তাই তাদের হুমকি, হামলা, উদ্ধত আস্ফালন এখনো অব্যাহত থাকতে পারছে।

আগের ধারাবাহিকতায় এই সময়কালেও বহু মানুষ বিনা বিচারে খুন হয়েছে ক্রসফায়ারের নামে, গুম হয়েছে বহুজন, পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে অনেকে, যাদের মধ্যে মুশতাক অন্যতম। এসব নিয়ে প্রতিবাদ বা প্রশ্ন তোলা ঠেকানোর জন্য করা হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীনতার আইন। এখন এই আইন বাতিল করার পরিবর্তে তাকে আরও জুলুমবান্ধব করার ব্যবস্থা হচ্ছে।

ত্বকীকে যারা খুন করেছে, তারা এই ব্যবস্থারই ভাগীদার এবং সুবিধাভোগী। যেসব খুনের বিচার হয় না, তদন্ত হয় না, সেগুলোর অপরাধীদের খুঁজলে তাদেরও এই জগতেই বসবাস দেখা যাবে। সে জন্যই খুনিদের বিচারে এত অনীহা, তদন্তে গাফিলতি, আবার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত লোককেও ক্ষমা করা! দুর্বৃত্ত জোট চায় সবাই এসব ঘটনা ভুলে যাক, সবাই মূক, বধির ও অচল হয়ে থাকুক। কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী হয় না, মানুষের জগৎ প্রতিবাদের দাবি নিয়ে বারবার সামনে আসে, বিচারের দাবিতে খুন হয়ে যাওয়া ত্বকীসহ জীবন্ত মানুষদের মিছিল বাড়তে থাকে। সেটাই আমাদের ভরসা।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকারের লোকজন ক্রসফায়ারের মিথ্যাচার দিয়ে খুন আর একের পর এক গুমের কথা অস্বীকার করছে। যাঁরা বলেন ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ইত্যাদি নামে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ হয় না, তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন যে এটা কত বড় মিথ্যা। দেশে গুম নেই, এটাও এ রকমই বড় মিথ্যা। মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখার রাষ্ট্রীয় অ্যাজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখল, লুটপাট, নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আটক-বাণিজ্য, অন্যের ভাড়া খাটার কারণে এসব হত্যা ও গুমযজ্ঞ চলছে। অপারেশন ক্লিন হার্ট দিয়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এর শুরু আর আওয়ামী লীগ সরকার এগুলো বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে এগুলো বন্ধ দূরের কথা, বরং বাড়িয়েছে। এখন মিছিল, সভা, স্থানীয় গন্ডগোল, আটক-বাণিজ্য—সর্বত্র গুম বা ক্রসফায়ার একটি হুমকি বা লেনদেনের দর-কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্রসংগঠনের ত্রাস, গণরুম নির্যাতন—সবই যেন নতুন খুনি সন্ত্রাসী তৈরির প্রশিক্ষণপর্ব। আর এসব ভয়ের অস্ত্র সব ক্ষমতাবান লুটেরা খুনি দখলদারেরই কাজে লাগে।

প্রশ্ন হলো, কেন সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দস্যু, খুনি, ধর্ষক, নদী-বন-জমি দখলদারদের রক্ষা করা, পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া তার কর্তব্য মনে করে? করে, তার মেলা কারণ আছে।

বাংলাদেশে এখন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো খেয়াল করলে বেশ কয়েকটি সংগঠিত শক্তি দেখা যাবে, ব্যাংক-ব্যবসা-পরিবহন-নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্র তার অন্যতম। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন উপায়ে তছরুপ হচ্ছে, সরকারি–বেসরকারি নানা গোষ্ঠীর মাধ্যমে হাজার হাজার একর খোলা জমি, বন-পাহাড়-নদী দখল হচ্ছে, প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার নামে খুন হচ্ছে। এসবের কোনো সুরাহা নেই। এসব বিষয়ে তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। সাধারণ বাসভাড়া বিষয়টা খেয়াল করলেই দেখা যাবে পরজীবীদের কর্তৃত্ব। বাসভাড়া যখন-তখন বাড়ে। লাইসেন্সসহ সব বিষয়েই অনিয়ম। কারণ, বাসে একজন যাত্রী যে ভাড়া দেন, তার ওপর বড় ভাগ থাকে চাঁদাবাজ আর কমিশনভোগীর।

জিনিসের দাম ক্রমাগত বাড়ছে কেন? পথে পথে, হাটে-বাজারে, ওপরে-পাশে চাঁদাবাজ আর কমিশনভোগীদের খাই খাই দিন দিন বাড়ছে, ভাগীদারও বাড়ছে। তাদের খিদের সীমা নেই। আর তার সঙ্গে আছে ‘উন্নয়ন’ মুরব্বি এডিবি-বিশ্বব্যাংকওয়ালাদের বহু পুরোনো চিনিমাখা লাইনে মুনাফার নীতি ও দুর্নীতির বন্দোবস্ত—ক্রমাগত গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সর্বজনের প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবসা ঢোকাতে হবে, দাম বাড়াতে হবে, যাতে দেশি-বিদেশি মাফিয়া গোষ্ঠীর রাস্তা পরিষ্কার হয়। এই উন্নয়নযাত্রায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিতে এমন সব প্রকল্প নেওয়া হয়, যাতে বড় ব্যবসায়ীদের মুনাফার রাস্তা তৈরি হয়, আর মন্ত্রী-আমলাদের ক্রমবর্ধমান বিলাসভোজন নিশ্চিত থাকে। তাতে ‘উৎপাদন ব্যয়’ বাড়তেই থাকে। এগুলোর অর্থ জোগাতে দাম বাড়ানোর বোঝা জনগণের ওপর চাপানোই সহজ সমাধান। একেকবার এগুলোর দাম বাড়ে, তখন আরেক দফা বাড়তে থাকে বাড়িভাড়া, বাসভাড়া, নানা রকম জিনিসের দাম। টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়ে কিছু মানুষ বাঁচতে চেষ্টা করে। পরজীবী ধনিকশ্রেণিকে আরও মোটাতাজা করতে মানুষের ওপরই সব অপমান আর ভোগান্তির বোঝা। এসব চাঁদাবাজ ও কমিশনভোগী সরকারের ক্ষমতার খুঁটি। আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে তাই এদের ওপরই সরকারের ভরসা করতে হয়, রক্ষাও করতে হয়।

এখন দেশে যে উন্নয়নের তোলপাড় চলছে, তাতে কেনাকাটা আর দালান-টালান নির্মাণেই কর্তাদের আসল উৎসাহ।

স্যাটেলাইট থেকে বিমান, অস্ত্র থেকে ট্রাফিক সিগন্যাল—সবই দরকার। থাকুক বা না থাকুক, ভালো হোক বা মন্দ, আরাম বা বোঝা হোক, কাজ করুক বা না করুক, কেনাকাটাই আসল লক্ষ্য। ঢাকা শহরজুড়ে ট্রাফিক বাতির তামাশা তো আমরা প্রতিদিন দেখি—সবুজ হলে চলা বন্ধ, লাল হলে চলা শুরু। সবই ঋণের টাকায় কেনা। তুলনায় এত তুচ্ছ, ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে—সচিবালয় থেকে নানা দপ্তর, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনা হচ্ছে বহু জিনিস, যেগুলো কাজ করে না।

সাজসরঞ্জাম, মেশিন কেনা হয় খুব উৎসাহ নিয়ে, কিন্তু বাক্স থেকেও অনেকগুলো বের করা হয় না। এ ছাড়া ভবনসহ নির্মাণকাজেও তা-ই, নির্মাণেই ব্যাপক উৎসাহ, দরকার থাকুক বা না থাকুক। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামে কেনাকাটা আর নির্মাণকাজের টাকা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। মেগা প্রকল্প এগুলোর বড় সংস্করণ। সড়ক, রেল, সেতু, ভবন, বিদ্যুৎকেন্দ্র যা-ই হোক, এগুলোর খরচ অনেক ক্ষেত্রে ভারত, চীন—এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। কারণ, ছোট–বড়, নিচে–ওপরে এর ভাগীদার অনেক। সুন্দরবন, কক্সবাজারসহ নানা প্রাণকেন্দ্রবিনাশী প্রকল্পে দেশের ক্ষতি হলেও লাভবান তারাই। এসব চালাতে গেলে সব জায়গায় ত্রাস জারি রাখতে হয়, যাতে মানুষ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। সুতরাং লাঠিয়ালদের রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য।

ত্বকীকে যারা খুন করেছে, তারা এই ব্যবস্থারই ভাগীদার এবং সুবিধাভোগী। যেসব খুনের বিচার হয় না, তদন্ত হয় না, সেগুলোর অপরাধীদের খুঁজলে তাদেরও এই জগতেই বসবাস দেখা যাবে। সে জন্যই খুনিদের বিচারে এত অনীহা, তদন্তে গাফিলতি, আবার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত লোককেও ক্ষমা করা! দুর্বৃত্ত জোট চায় সবাই এসব ঘটনা ভুলে যাক, সবাই মূক, বধির ও অচল হয়ে থাকুক। কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী হয় না, মানুষের জগৎ প্রতিবাদের দাবি নিয়ে বারবার সামনে আসে, বিচারের দাবিতে খুন হয়ে যাওয়া ত্বকীসহ জীবন্ত মানুষদের মিছিল বাড়তে থাকে। সেটাই আমাদের ভরসা।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক