ত্বকীকে আমি চাক্ষুষ দেখিনি। মৃত্যুর পর তার ছবি দেখেছি। এক স্বপ্নভরা চোখের অধিকারী কিশোরের ছবি। মায়ের স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। সহপাঠীদের স্বপ্ন ছিল ত্বকীকে ঘিরে। শিক্ষকদের স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। নারায়ণগঞ্জবাসীর স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। সবচেয়ে বড় স্বপ্নটি দেখেছিলেন ত্বকীর মা স্বয়ং। তাঁর শিশুসন্তানটি যেদিন জন্মগ্রহণ করে তিনি সেদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর শিশুটির জন্য তিনি এই পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে যাবেন। নবজাতকের কাছে এই ছিল তাঁর আন্তরিক প্রতিজ্ঞা।
সেই সব ছোট-বড়-মহৎ স্বপ্ন ঘাতকের নিষ্ঠুর হাত ছিনিয়ে নিয়েছে নির্বিকার চিত্তে, হয়তো মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য। কোন ‘গডফাদারের’ নির্দেশ পালন করেছে তার অনুগত রোবটবৃন্দ, বিনিময়ে পেয়েছে আশ্রয়-প্রশ্রয়-অর্থ ও নেশা করার মাদক। শীতলক্ষ্যার শীতল জলে ত্বকীর দেহ ভাসিয়ে দেওয়ার সময় তাদের কোনো মায়া-দয়া হয়নি। হাত কাঁপেনি একবারও। হায় কী বোকা ও নিষ্ঠুর এই পৃথিবী! ঘাতকেরা জানল না কী বিশাল একটা সম্ভাবনাকে হত্যা করল তারা।
ত্বকীর জন্ম ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবরে। মৃত্যু (ঘাতকের জবানবন্দি অনুসারে) ৬ মার্চ ২০১৩ সালে। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে সে থাকতে পেরেছিল মাত্র ১৭ বছর পাঁচ মাস এক দিন। কেমনভাবে এই সময়টা সে কাটিয়েছে? সম্ভবত শেখ সাদি বা মির্জা গালিবের একটি শায়ের (বিজ্ঞ পঙ্ক্তিমালা) আছে উর্দুতে যেখানে তিনি বলেছিলেন,
‘পুঁছো মাৎ জিন্দেগি-মে
কেত্না পাল্ হ্যায়,
পুঁছো পালমে কেত্না
জিন্দেগি হ্যায়।’
আমার অনুবাদে,
‘আমাকে জিজ্ঞাসা করো না,
জীবনে কত মুহূর্ত আছে?
জিজ্ঞাসা কর, মুহূর্তের
মাঝে কত জীবন আছে?’
আসলেই কে কত দিন বাঁচল তা দিয়ে জীবনের সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। কে কত ভালোভাবে, সৃজনশীলভাবে বাঁচল, তা দিয়েই জীবনের সার্থকতা। আমি নিশ্চিত, মাত্র ১৭ বছরের এই কিশোরের জীবন ছিল খুবই ঠাসা ও ঘন। সৃজনশীল ও দুঃখহীন। মৃত্যুর আগে মেধাবী ত্বকী এ-লেভেল পরীক্ষা দিয়েছিল। সেখানেও রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষরও রেখেছিল। কিন্তু ওই ফল যখন প্রকাশিত হয়েছে, তখন ত্বকী তার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তাই অকালমৃত্যুও কখনো তার স্বল্পস্থায়ী (সময়ের বিচারে) জীবনের দীর্ঘস্থায়ী (কীর্তিময় জীবনের বিচারে) গুরুত্বকে ম্লান করে দিতে পারবে না। ত্বকী ইংরেজিতে অসাধারণ কবিতাও লিখে গেছে। তার বাবা সম্ভবত তার মৃত্যুর পর সেগুলো তার দিনলিপির পাতা থেকে উদ্ধার করে প্রকাশও করেছেন। নিখোঁজ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে কিশোর ত্বকী দ্বিধাহীনভাবে লিখে গেছে,
‘আমি প্রস্তর হয়ে মরলাম উদ্ভিদ হতে
উদ্ভিদ হয়ে মরি, তো উত্থিত প্রাণে—
মানুষ হয়ে উঠলাম পরে, যখন সত্য উদ্ভাসিত
হলো, ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?’
আমার কাছে মনে হয়েছে কী বিস্ময়কর এই পঙ্ক্তিমালা! মনে হয় নিজের ভবিষ্যৎ যেন নিজেই দেখতে পেয়েছে ত্বকী এবং কত উদারভাবে, সাহসের সঙ্গে নির্দ্বিধায় তাকে বরণ করে নিয়েছে। মৃত্যুকে যারা এভাবে দার্শনিক গভীরতা নিয়ে দেখতে পারে, তাদের মৃত্যু কখনো পরাজিত করতে পারে না। তারা প্রকৃতির অজেয় সন্তান। প্রকৃতি থেকে এসে প্রকৃতিতেই ফিরে যায় কিন্তু সেখানে তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকে অনন্তকালব্যাপী। নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি অলিতে-গলিতে, ধূলিতে-বালুতে, শীতলক্ষ্যার প্রতি ফোঁটা জলে, বাবা রফিউর রাব্বির সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ত্বকী আছে, ত্বকী থাকবে। ত্বকী এবং ত্বকীর বাবা তাই অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের প্রতীক।
ত্বকী তো নিহত হয়েছে অন্যায়ভাবে। কোনো নিজস্ব দোষ ছাড়াই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার ছিল একটাই মহা অপরাধ, সে ছিল রফিউর রাব্বির সন্তান। আর রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জের ক্ষমতাধর পরিবারের সঙ্গে আপস করতে রাজি ছিলেন না। এখনো তাঁর আপসহীন সংগ্রাম অব্যাহত আছে।
মানুষের সমাজে প্রাণ অপহরণ করার শাস্তি বা মূল্য হচ্ছে আরেকটি প্রাণের বলি বা শাস্তি। সেটাই স্বাভাবিক কারণ যে হত্যা করে, সে এমন একটি ক্ষতি করে যার কোনো ঐহিক মূল্য বা প্রাণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ক্ষতিপূরণ মূল্য নেই। তাই ত্বকী হত্যার স্বাভাবিক প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণ হচ্ছে হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি বিধান। হত্যাকারী ও তার নেপথ্য নায়কদের অবশ্যই আমাদের বিচার করতে হবে। কিন্তু হবে কি সেটা এ দেশে? আমার বিশ্বাস তা আজ হোক, কাল হোক হতেই হবে। প্রকৃতিতে দীর্ঘ মেয়াদে ভারসাম্য বিধান হবেই। ধর্মের কল শেষ পর্যন্ত আর কেউ না নাড়ালেও বাতাসই নাড়িয়ে দেয়। এটাই ত্রিকালদর্শীদের কথা। এ ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হবে না।
তাই নেপথ্যের ঘাতকেরা যদি আজ ভেবে থাকেন যে তাঁরা আইনকানুন, রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিতে পেরেছেন বলে মহাকাল ও সমাজকেও ফাঁকি দিতে পারবেন, ধর্মকেও ফাঁকি দিতে পারবেন, তাহলে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। একদিন তাঁদের ‘স্বর্গ’ থেকে অবশ্যই বিতাড়িত করা হবে। তখন তাঁরা থাকবেন মানুষের ঘৃণার নরকে এবং তাঁদের দখল করা স্বর্গ সত্য সত্যই সবার জন্য প্রকৃত স্বর্গে পরিণত হবে। নারায়ণগঞ্জ ‘অ-নারায়ণকে’ বিতাড়িত করে ‘নারায়ণের’ আবাসস্থলে পরিণত হবে। সেই স্বপ্ন ত্বকীর কাছ থেকে, ত্বকীর জননীর কাছ থেকে আমরা ধার করেছি, সেই স্বপ্ন-ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত, সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মানুষের সংগ্রামও শেষ হবে না। অমানুষের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম—এই পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রামে যতটুকু সাফল্য আসবে—ঠিক ততটুকুই আমরা নিজেদের মানুষে পরিণত করতে পারব।
আজ আমাদের সমাজে যে শিশু-কিশোর হত্যার মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর মানসিকতা দেখা যাচ্ছে, হয়তো তার শুরু ত্বকী হত্যা থেকেই। যদি ত্বকীর হত্যাকারীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যেত, যদি হত্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা যেত, তাহলে হয়তো অনেক ঘাতকের হাত কাঁপত, হয়তো অনেক শিশু-কিশোরের জীবন বেঁচে যেত।
এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।