আজ ৫ অক্টোবর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন। ২৬ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু আজ থেকে সাড়ে আট বছর আগে মাত্র ১৭ বছর ৫ মাস বয়সে তার মৃত্যু হয়েছে। কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে শীতলক্ষ্যার জলে। হতে পারত তার সলিলসমাধি। না, তা হয়নি। শীতলক্ষ্যার জল তাকে পাড়ে ঠেলে এনেছে।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ যেদিন ত্বকী নিখোঁজ হয়, এর পরদিন তার এ-লেভেল প্রথম পর্বের ফল প্রকাশিত হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে তিনটি পর্বে ২৯৭/৩০০ ও রসায়নে তিন পর্বে ২৯৪/৩০০ নম্বর পেয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানেরটি বিশ্বে সর্বোচ্চ ও রসায়নেরটি ছিল দেশে সর্বোচ্চ নম্বর। কিন্তু আমরা তখন সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজছি ত্বকীকে। আমাদের কারও চিন্তা বা কল্পনাতেও ছিল না এর পরদিন যে বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা হলাম। ৮ মার্চ সকালে পুলিশ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। ত্বকীর কোনো শত্রু ছিল না। কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে। চোখ উপড়ে এনেছে। দেহের মধ্যভাগের একটি অঙ্গ থেঁতলে দিয়েছে। মাথায় তিন দিক থেকে আঘাত করা হয়েছে। এক ঘাতকের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি অনুযায়ী গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর তার বুকের ওপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে তারা মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।
জন্মদিনে ত্বকী গান গাইত, ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার/ আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার’, গাইত, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়’। লালনের গানও তার খুব প্রিয় ছিল। লালনকে নিয়ে ইংরেজিতে ছোট্ট একটি লেখা লিখেছিল খেরোখাতায়। মৃত্যুর পর তার কয়েকটি খেরোখাতায় পাওয়া যায় বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কিছু কবিতা, গদ্য, দু-চারটি ছোট গল্প, বিস্তৃত ভাবনার সমাহার। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলায় লেখা ছোট ছোট পঙ্ক্তি। এক জায়গায় লিখেছে, ‘সমগ্র মানব জাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে— / হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ সে সময়ের শাহবাগের সংগ্রাম নিয়ে লিখেছে, ‘হৃদয়ে আজ নব বসন্তের গান/ পাখির ডাকের সাথে ধ্বনিত হচ্ছে শাহবাগের স্লোগান।’
বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ছিল। নির্ধারিত পাঠ্যতালিকার বাইরের বইয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। ছবি আঁকত, ভালো আবৃত্তি করত। দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ করে ফেলত। কবিতার মূল সুরটি সহজে ধরতে পারত। বাতাসে কান পাতলে এখনো শুনতে পাই সে কণ্ঠস্বর, ‘মেঘের মধ্যে মাগো যারা থাকে,/ তারা ডাকে,/ আমায় ডাকে।’ আক্ষরিক অর্থেই হয়তো সে ডাক ত্বকী শুনতে পেয়েছিল। ভালো দাবা খেলত। প্রথম প্রথম ইচ্ছে করেই খেলায় হারতাম। পরে সত্যি সত্যিই সে হারিয়ে দিত।
দেশের বাইরে যেতে চাইত না। বলেছিলাম এ-লেভেল করে বাইরে চলে যেয়ো। পাঠ শেষে ফিরে আসবে। প্রশ্ন করেছিল, দেশের পড়াশোনা কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে? বললাম, তা নয়, আমাদের সামনের মানুষগুলোর অনেকেই তো বাইরে গেছেন। বাইরে যাওয়াটা দোষের কিছু নয়। দেশটাকে ভালো করে জানার জন্যও বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তখন কিছুই না বললেও, পরে মাকে বলেছিল, তোমাদের ছেড়ে বাইরে গিয়ে একা থাকতে পারব না। জানতে ইচ্ছে করে, আজ সাড়ে আট বছর একাকী কী করে আছ?
‘আবুল হাসানের কবর থেকে ফিরে’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘কবরে কী করে পড়ো? মাটি কি কাগজ খাতা?/ তোমাকে মৃতের পাশে রেখে, ফিরে আসে তোমার কবর।/ আমাদের প্রত্যহের প্রবাহিত পাপে/ স্মৃতি তাপে জ্বলছিল প্রাণ/ এই চোখ মৃত্যু দেখে কোনো দিন কাঁদেনি/ শুধু প্রাণ কেঁদেছিল একবার...।’
সাড়ে সাত বছর আগে তদন্তকারী সংস্থা র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, নারায়ণগঞ্জের পরিচিত এক প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান পরিবার তাদেরই টর্চার সেলে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। কিন্তু অদ্যাবধি হত্যার বিচার শুরু হলো না। ঘাতকের শক্তি-মত্তা, শৌর্য-বীর্যের পাথুরে দেয়ালে কেবলই মাথা ঠুকছে আমাদের বিচারের কাঠের হাতুড়ি।
দেশে, দেশের বাইরে কতশতজন বিচার চেয়ে চলেছেন। কতজন মৃত্যু বরণ করেছেন বিচার চাইতে চাইতে। কবি রফিক আজাদ ‘জবাব দাও বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তাদের সুতীক্ষ্ণ রক্তচোখের ভেল্কিবাজিতে আমি চন্দ্রাহত হই!/ আহত হয় আমার স্বাধীনতা/ পতাকা ম্লান করে শোকাকুল মায়ের ব্যাকুলতা/ পিতার আহাজারি আর বোনের আর্তচিৎকার।/ ত্বকীর মতো কিশোরের রক্তে শীতলক্ষ্যার পানি আজ একাকার!/ দানবতুল্য এই হায়েনাদের জন্য কি মুক্তিযুদ্ধ করেছি একাত্তরে?/ জবাব দাও বাংলাদেশ, নইলে/ আমাকেই করো তিরস্কার।’
কিন্তু জবাব যে দিতেই হবে। একাত্তরের বাংলাদেশ যে দানবের, হায়েনার, ঘাতকের অভয়ারণ্য হতে পারে না, হতে দেওয়া যাবে না।
রফিউর রাব্বি তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব