তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই বিবেচনাতেই ভুল সিদ্ধান্ত

আধুনিক বিশ্বে জ্বালানি তেলের দোর্দণ্ড ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছিল আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়। সে সময় ইসরায়েল সিনাই, পশ্চিম তীর ও গোলান মালভূমি দখল করেছিল। কয়েক সপ্তাহের সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধে ঠুঁটো জগন্নাথ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর অধিকার ছেড়ে দিয়ে আরব বিশ্বকে নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই অসহায় আত্মসমর্পণের প্রতিশোধ হিসেবে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেকভুক্ত দেশগুলো তাদের তেল উত্তোলন ৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও (পশ্চিম) ইউরোপীয় দেশগুলোয় তেল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

এই নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়লেও আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোর ওপর পড়া অভিঘাতও উপেক্ষা করার মতো ছিল না। অথচ তখন দেশের বিভিন্ন খনি থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ছিল আরব বিশ্বের সস্তা তেলের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিল বিশ্বের মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ, আর তারা ব্যবহার করত সারা দুনিয়ার উৎপাদিত তেলের এক-তৃতীয়াংশ। ওপেকের অবরোধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২ ডলার থেকে একলাফে বেড়ে ১১ ডলারে দাঁড়ালে গ্যাসোলিনের দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়ে সবচেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা হয় যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িনির্ভর মানুষের। উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে ওপেক এবং উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট তেল আমদানি বেড়ে চলছিল। ১৯৭৭ সালে এই পরিমাণ ছিল দৈনিক ৮৮ লাখ ব্যারেলের বেশি।

ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি কখনোই কাম্য নয়, তবু সরকার প্রতিবছর সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়, জ্বালানি তেলের ভর্তুকি ছিল তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়, কারণ এটির সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের অর্থনীতি ও তার প্রবৃদ্ধি।

ওপেকভুক্ত দেশগুলোর ১৯৭৩ সালে আরোপিত তেল নিষেধাজ্ঞার পরের বছর (১৯৭৪) যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তেল উৎপাদনকারী শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, এই নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলে যুক্তরাষ্ট্র আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছিল। এ কারণে পরের মাসেই আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের ওপর তেল-নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কিন্তু তত দিনে তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, পরের বছরেই তা নেমে আসে ২ দশমিক ১ শতাংশে। ১৯৭৫ সালে আরও নেমে হয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ক্ষমতাধর দেশগুলোর চাপে তেল-নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও এই প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে তিন বছর সময় লেগেছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগামী হারের চেয়ে বেশি বিরূপ প্রভাব দেখা গিয়েছিল বিশ্ববাণিজ্যে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বিশ্বব্যাপী স্থবির হয়ে যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, হ্রাস পায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ।

অবশ্য চার দশকের বেশি সময় পর যুক্তরাষ্ট্রের তেল পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ২০২০ সালে দেশটি নিট তেল রপ্তানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ বছর যুক্তরাষ্ট্র দৈনিক ৭৮ লাখ ব্যারেল আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৮৫ লাখ ব্যারেল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে কেবল আমেরিকার মতো গাড়িনির্ভর দেশের ওপর পড়ে তা-ই নয়, তেল আমদানিকারক সব দেশের ওপরও সমহারে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। আচমকা ঘোষণায় এক মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে (২৩%) ৮০ টাকা করা হয়েছে। এই উল্লম্ফনের কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের দাম, চোরাচালানি প্রতিরোধ, বিপিসির লোকসান ইত্যাদি বহু ধরনের যুক্তি দেখানো হয়েছে। এ কথা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের দাম ১০৪ টাকা, আবার শ্রীলঙ্কায় ৪৭, পাকিস্তানে ৭১, নেপালে ৮৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৮২ কিংবা যুক্তরাজ্যে ১৭৩ টাকা। ডিজেলের দাম বিশ্বের সর্বনিম্ন ইরানে ১ টাকা, আর সর্বোচ্চ হংকংয়ে ১৯৫ টাকা।

সুতরাং বিশ্বের কোন দেশে ডিজেলের দাম কত, সেটা বিচার করলে আমরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের দিকে তাকাতে পারি, সেসব দেশ থেকে ভারতে চোরাচালানের আশঙ্কাও বাংলাদেশের তুলনায় কম নয়। আবার যদি পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরি, তাহলে সেখানকার বাসভাড়ার কথা বিবেচনায় নেওয়া উচিত, যার হার আমাদের তুলনায় কম। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে অতীতে আমাদের জ্বালানি তেলের দাম কমানোর নজির রয়েছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডিজেলের দাম লিটারে ৪ টাকা কমিয়ে ৪৪ টাকায় কিংবা ২০১৩ সালে বর্তমান সরকারের সময়ে ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবার ২০০৭ সালে ৪০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা (৩৭%) বাড়ানোর দৃষ্টান্তও আছে।

কিন্তু অতীতের এসব উপাত্ত সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণে আসবে না, যখন তাদের ওপরই চাপবে মূল্যবৃদ্ধির সম্পূর্ণ বোঝা। আমাদের বুঝতে হবে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া কেবল একমাত্রিক বা এক স্তরের নয়, এটি বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। এটির প্রাথমিক ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি এবং আমাদের মতো সুশাসনের ঘাটতির দেশে এই হার হয় তেলের মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি, যেমন হয়েছে ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে গণপরিবহনের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্তে। অর্থনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই মূল্যস্ফীতির কারণে কমে যায় কার্যকর চাহিদা ও উৎপাদন, তার সঙ্গে বেড়ে যায় বেকারত্ব, অর্থনীতি ধাবিত হয় স্থবিরতার দিকে। এ ধরনের মূল্যস্ফীতিকে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত (কস্ট পুশ) বলে, একে রোধ করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে ভোক্তাস্তরের মানুষকেই অসহায়ভাবে এই মূল্যবৃদ্ধির শিকার হতে হয়।

ডিজেল-কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে-বিপক্ষে বহু কথাই বলা যায়, কিন্তু করোনাবিধ্বস্ত এই সময় এ রকম সিদ্ধান্ত কতখানি সুবিবেচনাপ্রসূত, সে প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিক। এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—উভয় বিবেচনায় ভুল। বর্তমান সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারিত আগের দুর্ভিক্ষ কিংবা চালের মূল্যস্ফীতির দুর্নাম বহু মূল্যের বিনিময়ে ঘোচাতে হয়েছিল। এই সাফল্যের মূলে ছিল দ্রব্যমূল্যের লাগাম নিয়ন্ত্রণ এবং চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা। ডিজেল বা কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি কেবল ফসল উৎপাদনের খরচই বাড়াবে না, পণ্য পরিবহন ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে, যা দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতাকে আক্রমণ করবে বিভিন্ন দিক থেকে। সেই বিরূপ প্রচারণা ও অভিযোগের ক্ষেত্র পুনর্বার তৈরি করে দিয়ে একলাফে এত বড় মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক ভুল। আর অর্থনৈতিক ভুলটি তাত্ত্বিকভাবেই প্রমাণযোগ্য, কারণ সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে সমগ্র অর্থনীতিই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।

ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি কখনোই কাম্য নয়, তবু সরকার প্রতিবছর সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়, জ্বালানি তেলের ভর্তুকি ছিল তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়, কারণ এটির সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের অর্থনীতি ও তার প্রবৃদ্ধি। লোকসানি, অদক্ষ ও অকার্যকর সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা বরং অর্থনীতির জন্য বোঝা, অন্যদিকে বিপিসিকে ভর্তুকি দিলে তার সুফল ভোগ করতে পারত দেশের সাধারণ মানুষ।

এই লেখার প্রথমভাগে আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিশ্বব্যাপী কী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় কিংবা আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর দেশ ও তার উচ্চ আয়ের মানুষকে কীভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। সেই দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের মতো ছোট দেশের অর্থনীতি ও নিম্ন আয়ের মানুষকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেটা প্রমাণের জন্য কাউকে অর্থনীতিবিদ কিংবা বিশ্লেষক হতে হয় না।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

fmainuddin@hotmail.com