মতামত

তেলা মাথায় তেল দেওয়া আর কত দিন

তৈরি পোশাক কারখানা।
ফাইল ছবি

‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’—কী সত্যই না উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! এই সত্য এখনো ছায়ার মতো আমাদের পায়ে পায়ে চলছে। ধনভান্ডার বরাবরই রাজাদের দখলে। সেখানে কাঙালের প্রবেশাধিকার নেই। বরং কাঙালের জন্য রয়েছে সেই আদি ও অকৃত্রিম ‘পারিষদ দল’, যারা ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে বরাবর। এমনকি ক্রান্তির সময়েও রাজাদের অর্থকড়ি লুটে বিরতি পড়ে না। বরং ত্রাণের মাল কেড়ে নিতে নিজেকে কাঙাল হিসেবে উপস্থাপনের উদারতা দেখাতেও তাঁরা সদা প্রস্তুত।

কথাগুলো আসছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের পাওয়া সংকটকালীন প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তার বিলিবণ্টনের পরিসংখ্যান দেখে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণায় উঠে এসেছে পীড়াদায়ক কিছু তথ্য। করোনা সংকট মোকাবিলায় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত সরকার, বিদেশি ক্রেতা ও দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ৬২ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা পায়। এই অর্থের ৮৩ দশমিক ৯৭ শতাংশই কারখানামালিকদের ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলায় বরাদ্দ হয়। আর বেতন-ভাতা বাবদ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এই অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে আবার বড় কারখানাগুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় মাণিকজোড়ের মতো ছিল রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও তদবিরের লম্ফঝম্ফ।

কাজ হারানো হাজারো শ্রমিকের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে কারখানার মালিকপক্ষ যত দিন সরকারি ও বিদেশি প্রণোদনার অর্থ হাতিয়ে নেবে, তত দিন এই বাস্তবতা থাকবে। যত দিন তেলা মাথায় তেল দেওয়া নীতিটি জারি থাকবে, তত দিন এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি নেই।

শেষোক্ত দুটি বিষয় নিয়ে বলার কিছু নেই। এ দুটি যেন কপালের লিখন। রাজনীতি তো রাজার স্বার্থ দেখতেই, নাকি? তা না হলে তো কবেই এই নীতির নাম ‘গণনীতি’ হওয়ার কথা ছিল। সে অন্য আলাপ। মোদ্দা কথা হলো রাজনীতি এখনো গণনীতি হয়ে ওঠেনি। ফলে জনতার প্রভাবের প্রসঙ্গটিই অবান্তর। রাজাই একমাত্র মুখ্য। আর রাজা মুখ্য বলে রাজ গোত্রীয় লোকেদের সুবিধা পাওয়াটাই নীতি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের নেতৃত্ব অনেক দিন ধরেই তৈরি পোশাকশিল্পের কাছে। লাখো শ্রমিক এই খাতটির সঙ্গে যুক্ত। এই শিল্পের মালিকপক্ষের রয়েছে প্রভাবশালী সংগঠনও। কিন্তু তারপরও যেকোনো দুর্যোগে তারা সবার আগে ‘যায় যায় রব’ তোলে।

এবারও এই করোনাকাল শুরু হলে তৈরি পোশাক খাত শিল্প বাঁচাতে সরকারি প্রণোদনার দাবি তোলে। এত বড় একটি খাতের টিকে থাকার প্রশ্নে এমন দুর্যোগে সরকারের এগিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকার পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে—চার দশক ধরে বিকশিত হওয়ার পরও এবং দেশের শীর্ষ রপ্তানিমুখী খাত হওয়া সত্ত্বেও তৈরি পোশাক খাত এখনো কেন এতটা প্রণোদনানির্ভর? সংযুক্ত প্রশ্ন হিসেবে যেটি সামনে আসে, তা হলো সরকার, বিদেশি ক্রেতা ও দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রণোদনা পাওয়ার প্রক্রিয়া চলমান অবস্থাতেই কেন করোনা সংকটের শুরুর ধাপেই শ্রমিক স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে ও আইনের তোয়াক্কা না করে কারখানা লে-অফ করা হলো? যেসব কারখানা এমন কাজ করল তাদের বিরুদ্ধে এই খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ কী পদক্ষেপ নিয়েছে? প্রশাসনের তরফেই-বা কী করা হয়েছে?

বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের স্বার্থের প্রশ্নে সরকার মালিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই করোনাকালেও তার কিছু রূপ দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাজরীন কারখানার আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের কথা বলা যায়। সেই আন্দোলনে সরকার কর্ণপাত তো করেইনি, উপরন্তু গভীর রাতে অবস্থান কর্মসূচিতে থাকা শ্রমিকদের পিটিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে। আহত শ্রমিকদের আরও আহত করতে একবারও বুক কাঁপেনি। একই ভাবে ১১ মাসের বকেয়া বেতন-ভাতার দাবি নিয়ে অবস্থান কর্মসূচিতে থাকা এ-ওয়ান কারখানার শ্রমিকদেরও পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ড্রাগন সোয়েটারের শ্রমিকদের কথাও। আন্দোলনের মাধ্যমে মালিক, সরকার ও শ্রমিকদের মধ্যে চুক্তির হওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত ন্যায্য পাওনা পাননি শ্রমিকেরা। এই সব ঘটনাই ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে এই করোনাকালেও।

ফলে এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শ্রমিকেরা তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বরাদ্দ হওয়া প্রণোদনার অর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তাঁরা তুলছেনও। কিন্তু এই প্রশ্ন বারবার আটকে যাচ্ছে ওই রাজাদের সমীকরণে এসে। শ্রমিক স্বার্থে অজস্র আইন থাকলেও শ্রমিকের সঙ্গে মালিকপক্ষের আচরণ বরাবরই ‘নিপাতনে সিদ্ধ’, যা কিনা কোনো আইনের ধার ধারে না। প্রশাসনের তরফ থেকেও এ ক্ষেত্রে একচোখা নীতি নেওয়া হচ্ছে বললে—অত্ত্যুক্তি হবে না। না হলে কেন বারবার খেয়ে-পরে বাঁচার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া শ্রমিকেরাই রবিঠাকুরের ‘উপেন’ হয়ে উঠবেন। কেন বেতন-ভাতা বা ক্ষতিপূরণ চাইতে গিয়ে উল্টো তাঁদের মার খেয়ে আসতে হবে, যখন এমন দাবি তোলার কোনো বাস্তবতা চার দশকের পুরোনো একটি শ্রম খাতে থাকারই কথা নয়? অথচ আছে। এবং ভীষণ পীড়াদায়কভাবেই আছে। কাজ হারানো হাজারো শ্রমিকের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে কারখানার মালিকপক্ষ যত দিন সরকারি ও বিদেশি প্রণোদনার অর্থ হাতিয়ে নেবে, তত দিন এই বাস্তবতা থাকবে। যত দিন তেলা মাথায় তেল দেওয়া নীতিটি জারি থাকবে, তত দিন এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি নেই। আরও ভালো করে বললে, যত দিন শিল্পমালিক ও আইনপ্রণেতার পরিচয় একই থাকবে, তত দিন এই বাস্তবতা থাকবে।

ফজলুল কবির: লেখক ও সাংবাদিক

fazlul.kabir@prothomalo.com