তুষারধস বনাম কতিপয় উপাচার্যের মূল্যবোধের ধস

এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই গলে যেতে পারে এভারেস্টচূড়ার হিমবাহ। এই হিমবাহ গড়ে উঠতে লেগেছে দুই হাজার বছর। আর তা গলে যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৫ বছর। প্রথম আলো ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এনডিটিভির সূত্রে দ্য ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্টের গবেষণাপত্রের প্রতিবেদন ধরে এই খবর প্রকাশ করেছে!

ধরিত্রীর তাপমাত্রা যে বেড়ে যাচ্ছে, জলবায়ুর বদল ঘটছে, তুষার দ্রুত গলছে, সমুদ্রপানির তল উঁচু হচ্ছে, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বন্যা হচ্ছে—এসব তো পৃথিবীবাসী নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, চীনে নজিরবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু ঘটছে, সংবাদমাধ্যম সেসব খবরে আকীর্ণ। আর ২০৫০ সালে সমুদ্রতল ৫০ সেন্টিমিটার উঁচু হবে—পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, এর মানে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ জমি লোনাপানিতে ডুবে যাবে, ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হবে। (সূত্র: এনভায়রনমেন্ট জাস্টিস ফাউন্ডেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ)। আর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যা-খরা-নদীভাঙনে দেশের কোটি কোটি মানুষ হয়ে পড়বে বিপর্যস্ত।

অন্যদিকে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হয়ে উঠবে পৃথিবীর ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, বাংলাদেশের জিডিপি ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে হবে ৩ হাজার ৬৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ একদিকে আছে জয়ের খবর, আরেক দিকে আছে ক্ষয়ের খবর। দুটো মিলে কী হবে, তা নিয়েও গবেষকেরা গবেষণা করছেন। হিমালয়ে কিংবা উত্তর মেরুর হিমবাহের ধস গবেষকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।

কিন্তু আরেকটা ধস কি আমরা আমাদের হিসাবের মধ্যে রাখছি? তা হলো মূল্যবোধের ধস। আর তার একটা ইন্ডিকেটর বা সূচক হতে পারে কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় উপাচার্যকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর প্রথম আলোয় উপাচার্যদের নিয়ে আছে কমপক্ষে তিনটা খবর। ‘খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির চিত্র ফুটে উঠল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউজিসির তদন্তে। এতে দেখা যায়, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক, শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। নিজের স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই তা আটকে যায়।’

তদন্ত কমিটিকে উপাচার্য বলেছেন, ‘এটা আসলে খুব ভালো কাজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে গিয়ে এ রকম করতে হয়েছে। আমি এই অন্যায় কাজটি করেছি।’ খবরের কাগজে এই সরল স্বীকারোক্তি আমাদের রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন মনে করিয়ে দেয়, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।’

এই খবরের পাশে প্রথম আলোয় আছে পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর: ‘শেষ সময়ে এসে উপাচার্যের তড়িঘড়ি নিয়োগের চেষ্টা: বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন্ট বোর্ডের সভায় আজ ১০২ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।’ আর বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয় আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর: উপাচার্য ফরিদউদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আবার সরব হয়ে উঠেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

আমাদের মনে পড়বে যে ২০১৯ সালের অক্টোবরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগির একটি ফোনালাপের অডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল। ২০২১ সালে নানা অনিয়মের অভিযোগে উপাচার্য অপসারণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কালিমউল্লাহকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীরা আর গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়ে না, শুধু টিকচিহ্ন দেওয়া শেখে; মানবিক বিষয় তো আকর্ষণীয় নয়ই, বিজ্ঞানও আর আকর্ষক নয়, এখন সবাই পড়তে চায় বাণিজ্য, কারণ বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। মূল্যবোধ শিখব, এমন আদর্শ সামনে নেই; চারদিকে শুধু খাই খাই আওয়াজ। ক্যাসিনো থেকে মাদক, রাতের রাজারা এখন দিনের রাজা হয়ে উঠছেন। নদী-বন-মাটি-আকাশ-বালু-ব্যাংক, সব হজম হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ই-মার্কেটিংয়ের নামে পাবলিকের টাকা পকেটে পুরে কেটে পড়ার চল।

২০২১ সালে ডয়চে ভেলে খবর প্রকাশ করেছিল: ‘দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৪৬টি। তার মধ্যে গত দুই বছরে ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আর পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত চলছে।’

১৭ এপ্রিল ২০২১ প্রথম আলোয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু শামীম মোহাম্মদ আরিফ মতামত কলামে লেখেন: ‘দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়েছে। কাজটি করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক সংস্থা হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে শেষের দুটির সাবেক এবং প্রথম ছয়টির বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

এর বাইরে আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে তদন্ত শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। আইনে সংশোধন ও শর্ত শিথিল করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করে আগের জায়গায় আইন ফিরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পত্রিকার মাধ্যমে উপাচার্য কর্তৃক ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে অবৈধভাবে শিক্ষক বহিষ্কার ও অপসারণের মতো তুঘলকি কাণ্ডও আমরা জানতে পারছি। উপাচার্যরা কেন এবং কীভাবে এ-জাতীয় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে।’

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা বা পারসেপশনের কী হাল, তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষাগুরুদের নিয়ে যখন সংবাদপত্রে এই ধরনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তখনই একজন সংসদ সদস্য প্রকৌশলী আর চিকিৎসকদের নিয়ে কটূক্তি করে প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন। সেই খবরের নিচে পাঠকদের মন্তব্যগুলো কিন্তু খুবই নেতিবাচক। আমি তা উদ্ধৃত করে বিপদ ডেকে আনতে চাই না। শিক্ষিতদের অবস্থা নেমে গেছে এই পর্যায়ে।

এখন দুই বছর হলো স্কুল-কলেজ বন্ধ। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে, এই কথা প্রায় সবাই বলেন। শিক্ষার্থীরা আর গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়ে না, শুধু টিকচিহ্ন দেওয়া শেখে; মানবিক বিষয় তো আকর্ষণীয় নয়ই, বিজ্ঞানও আর আকর্ষক নয়, এখন সবাই পড়তে চায় বাণিজ্য, কারণ বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। মূল্যবোধ শিখব, এমন আদর্শ সামনে নেই; চারদিকে শুধু খাই খাই আওয়াজ। ক্যাসিনো থেকে মাদক, রাতের রাজারা এখন দিনের রাজা হয়ে উঠছেন। নদী-বন-মাটি-আকাশ-বালু-ব্যাংক, সব হজম হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ই-মার্কেটিংয়ের নামে পাবলিকের টাকা পকেটে পুরে কেটে পড়ার চল।

হিমালয়ের তুষারধসের জন্য আমরা দায়ী নই, কিন্তু মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার ধসের জন্য তো আর কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। আমরাই দায়ী। বিজ্ঞান হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি রোধ করার উপায় বের করে ফেলবে, কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সামনে যে নীতিহীনতার অতল খাদ, তা থেকে তাদের উদ্ধার করবে কে?

আমরা ছোটবেলায় কবিতা পড়েছিলাম:

শিক্ষক কন-‘জাহাঁপনা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,

কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?’

বাদশাহ্ কহেন, ‘সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে

নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,

পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।

নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে

ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।’

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে

কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-

‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,

সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’

শিক্ষকদের পায়ে হাত দিয়ে পা প্রক্ষালন করে দিতে হবে, ছাত্ররা এই রকমভাবে শ্রদ্ধা করবে শিক্ষকদের। এই সমাজে এ ধরনের শিক্ষকই তো ছিলেন। কোথায় গেলেন তাঁরা? কেন ছাত্ররা, সহকর্মীরা একেকজন উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য আন্দোলনে নামেন? এর পেছনে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের হাজার কোটি টাকা, দলীয় রাজনীতি, যোগ্য মানুষকে উপাচার্য (বা শিক্ষক পদে) নিয়োগ না দেওয়া, নাকি এটা এই দেশ-সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের একটা সাধারণ সূচক মাত্র?

এখন প্রকৃত আশাবাদীর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনোই উপায় থাকল কি?

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক