সেনা–অভ্যুত্থান আর তুরস্ক, একে ওপরের প্রতিচ্ছবি। গত পাঁচ দশকে চারবার ক্ষমতা দখল করেছে তুরস্কের সেনাবাহিনী। প্রতিবারই মিলেছে পশ্চিমাদের সদয় সম্মতি। বেড়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। তবে ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে তুরস্কের সেনাবাহিনীর মধ্যে দলবদ্ধ হওয়া ‘গুলেন মুভমেন্ট’ সদস্যদের সেনা–অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছিল জনতা। জয় হয়েছিল জনতার। সেনারা ফিরে গিয়েছিলেন ব্যারাকে। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্কের নাজুক অবস্থান, পশ্চিমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আর দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা তুরস্কে আবার সেনা শাসন ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জনপরিসরে সেনা-অভ্যুত্থানের গুঞ্জন বাড়ছে। সেই গুঞ্জনে আগুন ঢেলেছে মার্কিন থিংকট্যাংক র্যান্ড করপোরেশন। সাম্প্রতিক প্রকাশিত র্যান্ড করপোরেশনের তুরস্ক-সম্পর্কিত প্রতিবেদনে তুরস্কে আবার সেনা শাসন ফিরে আসার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
মার্কিন মালিকানাধীন র্যান্ড করপোরেশন মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক গতিধারা পঠনে সুবিখ্যাত। র্যান্ডের আফগান আর ইরাক যুদ্ধ-সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো মনোযোগ কেড়েছিল সবার। বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বে মিত্র বাছাইয়ে পেন্টাগনকে সহায়তা করেছিল তারা, যা মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিধারা বদলে দিয়েছিল। পশ্চিমা ধ্যানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি। তুরস্ক–সম্পর্কিত র্যান্ডের ২৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তুরস্কের ভবিষ্যৎ–সম্পর্কিত বিষয়গুলো উঠে এসেছে। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তুষ্টির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণের কথা, তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্যসহ সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতির কথা।
২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে গুলেন মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে প্রায় ২০ হাজার সেনা কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। গ্রেপ্তার হন অসংখ্য। সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই বেদম ধরপাকড়ে অসন্তুষ্ট, বিশেষ করে জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীকে বেসামরিকীকরণও প্রতিবেদনে অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদতে বেসামরিকীকরণের মধ্য দিয়ে সেনা মজলিশে সেনাদের একক আধিপত্য খর্ব করা হয়েছে। সেনা মজলিশে যুক্ত করা হয়েছে বেসামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের। সেনা কর্মকর্তাদের এই বেশুমার ছাঁটাইয়ে মার্কিনরা বেজায় অসন্তুষ্ট। ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে যা বারবার উচ্চারিত হয়েছে মার্কিন জেনারেলদের মুখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময় থেকেই তুরস্কের সেনাবাহিনী একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছিল। আর্থিক থেকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা রক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই। তবে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা–অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর ‘স্বায়ত্তশাসিত’ মর্যাদা রদ করে একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়। স্বায়ত্তশাসন রদের বিষয়টি সেনাবাহিনীর উচ্চ মহল, তথা ‘এস্টাবলিশমেন্টকে’ খেপিয়ে তুলেছে। যারা মোটাদাগে গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশকে এগিয়ে নিতে চান, তাঁদের চোখে এই বেসামরিকীকরণ গত এক শ বছরের মধ্যে তুর্কি সেনাবাহিনীর কাঠামোগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একই সঙ্গে এই বেসামরিকীকরণ সেনাবাহিনী-সিভিল সোসাইটি সম্পর্ককে গণতান্ত্রিকও করতে পারে।
২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে তুরস্কের বিমানবাহিনীর অধীন স্কুলসমূহ বন্ধ করে নতুন জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটা সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের ‘এস্টাবলিশমেন্টের’ ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং সীমিত করেছে। বিমানবাহিনীর অধীন স্কুলসমূহ বন্ধ করে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেছে একেপি এবং এরদোয়ান। প্রথমত, কট্টর আতাতুর্কপন্থীদের দখল থেকে বিমানবাহিনীর অধীন স্কুলসমূহকে মুক্ত করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা। যার দরুন সব শ্রেণির নাগরিক সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুযোগ পাবে। সেনাবাহিনীতে সৃষ্টি হবে ভারসাম্য। ঠেকানো যাবে ভবিষ্যৎ সেনা–অভ্যুত্থান। কারণ, গত এক শ বছর ধরেই এই স্কুলসমূহ এলিট তুর্কিদের দখলে। যে এলিটরা বারবার আতাতুর্কের আদর্শ রক্ষার নামে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে। সৃষ্টি করেছে অরাজকতা। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী থেকে গুলেন মুভমেন্টকে উৎখাত। সেনাবাহিনীর মতোই সেনা স্কুলগুলো স্বায়ত্তশাসিত ছিল। স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নিয়ে আশির দশক থেকে গুলেন মুভমেন্ট সেনাবাহিনীর অধীন স্কুলসমূহে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সেনাবাহিনী থেকে বামপন্থীদের খেদানোর নামে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে গুলেন মুভমেন্টের অনুসারীরা। গুলেন মুভমেন্টের এই অনুসারীরা বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে নিজস্ব লোকদের সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন করে। আর এরাই ছিল ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা–অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে।
২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা–অভ্যুত্থানকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষ করে সিরিয়া যুদ্ধের সমীকরণ থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সিরিয়ায় আঙ্কারার স্বাধীন অবস্থান পশ্চিমাদের দর্পকে হুমকি দিয়েছে অনবরত। আর পশ্চিমারা তুরস্কের এই হুমকির জবাব দিয়েছে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা–অভ্যুত্থানে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে এবং তুরস্ককে একটি শরণার্থীর গুদাম বানিয়ে। বর্তমানে তুরস্কে সিরিয়ার ৪০ লাখসহ প্রায় অর্ধকোটি শরণার্থীর বসবাস। সিরিয়ার গৃহহীন ৪০ লাখ শরণার্থী তুরস্কের দৈনন্দিন সমাজকাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক, আবাসন, নিরাপত্তা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক কাঠামো অনেকটাই সিরিয়ার শরণার্থীদের ঝড়ে নাস্তানাবুদ।
সৌদি বলয়ের রাষ্ট্রসমূহের অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ আর রাজনৈতিক বিরোধিতা তুরস্কের নাস্তানাবুদ অবস্থাকে দুর্যোগে রূপান্তর করেছে। যে দুর্যোগ এরদোয়ানের একক ক্ষমতাকে ডিঙিয়ে দুই দশক পর স্থানীয় নির্বাচনে আঙ্কারা, ইস্তাম্বুলে বিজয়ী করেছে বিরোধীদের আর একেপিকে ভেঙে করেছে তিন ভাগ। এই দুর্যোগের মধ্যেই লিবিয়ার যুদ্ধ আর রাশিয়ার ইদলিব হামলা এরদোয়ানের রাজনৈতিক বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ এই রাজনৈতিক অবস্থান সেনা শাসনের পথ সুগম করতে পারে।
সিরিয়ার যুদ্ধের শুরুর পর থেকেই তুরস্ক ধীরে ধীরে পশ্চিমা ও ন্যাটো বলয় থেকে দূরে সরে গিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার নিকটবর্তী হয়ে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্যপদের জন্য ঘাম ঝরিয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্যপদ পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য না লড়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। এই ঘোষণা ছিল আঙ্কারার পশ্চিমা বলয় থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক বলয়ে যুক্ত হওয়ার চিন্তা; যা ছিল পশ্চিমাদের প্রতি একপ্রকারের যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। এই সংকটজনক অবস্থার মধ্যেই আবার আঙ্কারার রাশিয়ার তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা এস৪০০ কেনার ঘোষণা পশ্চিমাদের সার্বিকভাবে একেপি ও এরদোয়ানের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়। পশ্চিমারা এরদোয়ানের বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। এই বিকল্পের প্রথম ধাপ ছিল ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা–অভ্যুত্থান। আর দ্বিতীয় ধাপ হলো সিরিয়ায় পিকেকে আর লিবিয়ায় হাফতারকে সমর্থন এবং প্রায় দুই দশকেরও বেশি একসঙ্গে কাজ করার পর নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এফ৩৫ প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বহিষ্কার করে।
পশ্চিমাদের লাগাতার বিরোধিতা এরদোয়ানকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অসহায় করেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুরস্কের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া ও ইরান। মার্কিনরা সৌদি বলয়কে সঙ্গে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ উত্তর আফ্রিকায় তুরস্কের অবস্থানকে সংকুচিত করেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আঙ্কারার এই নাজুক অবস্থানের মধ্যেই র্যান্ড করপোরেশনের অভ্যুত্থান–সম্পর্কিত প্রতিবেদন তুরস্কের ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক চর্চাকে আরও শঙ্কিত করবে নিঃসন্দেহে।
রাহুল আনজুম: গবেষক