দূরদেশ

তুরস্কে গণতন্ত্রের নতুন মুখ

তুরস্কের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ঘটনা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। নির্বাচনের আগে জনমত জরিপগুলো এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি, যাতে করে এ ধরনের ফলাফলের কথা ভাবা যেতে পারত। নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে একেপির এই প্রত্যাশা নিয়ে সংশয় থাকলেও তাদের কার্যত পরাজয়ের কথা কেউ ভাবেননি। যদিও দল হিসেবে একেপি এই নির্বাচনেও সবচেয়ে বড় দল হিসেবেই নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু এককভাবে দলটি ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে। তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ৪১ শতাংশ। সেই হিসাবে তারা ৫৫০ আসনের পার্লামেন্টে ২৫৮টি আসন লাভ করবে। এককভাবে সরকার গঠনে তাদের প্রয়োজন ছিল ২৭৬টি আসন। ১৩ বছরের মধ্যে একেপি এই প্রথম সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তবে পরপর চতুর্থবারের মতো তারা নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে নিজেদের স্থান ধরে রেখেছে। সেক্যুলারপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি), যারা দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তাদের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৩২, দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৮১; কুর্দিদের দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি) সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ৭৯টি আসন লাভ করেছে। তুরস্কের নির্বাচনের এই ফলাফলের আশু প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কে সরকার গঠন করবে সেটা স্পষ্ট নয় এবং সম্ভবত খুব শিগগিরই আরেকটি নির্বাচনের পথেই দেশ এগিয়ে যাবে। কেননা, একেপি-কে হয় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে নতুবা সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো দল একেপির সঙ্গে কোয়ালিশনের আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি দক্ষিণপন্থী দলটি, যাদের সম্ভাব্য শরিক ভাবা যেতে পারত, এই বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। ফলে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করলে আইনগতভাবে ৪৫ দিনের মধ্যে আবার নির্বাচন করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে তার চেয়েও বেশি উল্লেখযোগ্য যে এই ফলাফল ইতিমধ্যেই কতগুলো সুস্পষ্ট প্রবণতা এবং বার্তা তুলে ধরেছে, সেগুলো লক্ষণীয়।

সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের জন্য তাদের ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নাকি খুব শিগগিরই যদি নির্বাচন হয় তাতে তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে, সেটা এখন অনিশ্চিত

নির্বাচনের আগে একেপি এবং তার নেতা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁদের যে আকাঙ্ক্ষার কথা সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, তা হলো তাঁর দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলে তাঁরা সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করবেন এবং কার্যত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালু করবেন। এই নির্বাচন ছিল কার্যত এই বিষয়ে গণভোট। ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে তুরস্কের নাগরিকেরা ক্ষমতা এককেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। এরদোয়ান ১১ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনো তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট জনপ্রিয়, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষমতার প্রয়োগ এবং ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রস্থলে গেজি পার্ককে কেন্দ্র করে যখন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়, তখন এই বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে। সে সময় বিক্ষোভকারীদের সম্পর্কে সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের বক্তব্যে একধরনের দাম্ভিকতা প্রকাশিত হয়েছিল বলেই অনেকের মত। ফলে যদিও এরদোয়ান এই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না, তথাপি এই ফলাফলকে তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া রায় বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে। দলের সমর্থন ২০১১ সালের ৪৯.৮ শতাংশ থেকে কমেছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কুর্দিদের দল এইচডিপির সাফল্য। দলগতভাবে কুর্দিদের মধ্য থেকে এই প্রথম কোনো গোষ্ঠী নির্বাচনে অংশ নিল। পার্লামেন্টে আসন পেতে হলে যেকোনো দলকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ ভোট পেতে হবে এই বিধানের কারণে অতীতে কুর্দি প্রার্থীরা নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন করতেন। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে নির্বাচন করে দলটি সাড়ে ১২ শতাংশ ভোট লাভ করেছে। মনে রাখা দরকার যে দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ থেকে ২০ শতাংশ কুর্দি, তারা পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বের কুর্দিস্তান বলে পরিচিত এলাকায় বাস করে এবং তারা সব সময় অভিযোগ করে এসেছে যে তারা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (বিকেলে) এবং তার নেতা আবদুল্লাহ ওচালানের নেতৃত্ব একসময় শক্তিশালী ছিল। ওচালান প্রায় ১৬ বছর আগে আটক হয়ে বন্দী জীবন যাপন করছেন। সংঘাত অবসানের জন্য ২০১২ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে ওচালান এবং তঁার দলের আলোচনা শুরু হয়। ২০১৩ সালে ওচালান কারাগার থেকেই তাঁর দলের পক্ষে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন এবং এই বছর মার্চ মাসে এক ঘোষণায় তিনি সরকারের সঙ্গে যে ১০ দফা চুক্তি হয়েছে তা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তঁার দলকে সশস্ত্র পথ থেকে সরে এসে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যোগ দিতে বলেন। যদিও এইচডিপির সঙ্গে পিকেকের কোনো যোগাযোগ নেই, তবু এইচডিপির উত্থানকে তুরস্কের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে কুর্দিদের সমস্যা সমাধানের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এটাও লক্ষণীয় যে এইচডিপি কেবল কুর্দিদের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়নি, নির্বাচনে তারা বামপন্থীদেরও তাদের দিকে টানতে পেরেছে, জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমর্থনের জন্য তাদের চেষ্টা ছিল এবং তাতে সাফল্যও এসেছে। নির্বাচনের আগে এইচডিপির কার্যালয়ে এবং সমাবেশে কয়েক দফা হামলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও দলের নেতারা তাঁদের প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখেন। পিকেকের সঙ্গে চুক্তি, পিকেকের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশের অঙ্গীকার এবং এইচডিপির উত্থান ভবিষ্যৎ তুরস্কের জন্য এক ইতিবাচক ইঙ্গিত।
সেক্যুলারপন্থীদের দল হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান পিপলস পার্টি যদিও বিজয়ের মুখ দেখেনি, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে তারা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের আদর্শিক লড়াইকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাখতে চায়। তারা মিসরের পথ বেছে না নিয়ে ধৈর্য এবং দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের পথে এবং তুরস্কের নাগরিকদের সঙ্গে নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের জন্য তাদের ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নাকি খুব শিগগিরই যদি নির্বাচন হয় তাতে তাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে, সেটা এখন অনিশ্চিত। কিন্তু যা নিশ্চিত তা হলো তুরস্কের নাগরিকেরা এবং গণতন্ত্র দুই-ই বিজয়ী হয়েছে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।