‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’

Galib Mujahid

‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’—২০২০ সালে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্মমভাবে পিটিয়ে যুবক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পলায়নরত এসআই আকবরকে সীমান্তবর্তী খাসিয়াপল্লির স্থানীয় যুবকেরা ধরে তাঁকে প্রশ্নটি করেছিল। একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে করা হলেও প্রশ্নটি যেন দেশের পুরো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই! খাসিয়াপল্লির যুবকের মতো বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মনে সেই একই প্রশ্ন, ‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’ ‘তুমি ক্রসফায়ার দেওয়ার অধিকার পাইলা কই?’ ‘তুমি গুমের অধিকার পাইলা কই?’, তা সে সাহস করে বলতে পারুক আর নাই পারুক। মানুষ এখন দেখেও না দেখার, বুঝেও না বোঝার কিংবা মুখ বুজে থাকা নিরাপদ বোধ করছে।

গত এপ্রিলে কুমিল্লায় র‍্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মোহাম্মদ রাজুর বাবা সন্তানের মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সন্তান অপরাধ করে থাকলে দেশে আইন ছিল, আদালত ছিল। সেখানে তার বিচার করতে পারত। কোনো যাচাই-বাছাই তদন্ত ছাড়া আমার ছেলেকে র‍্যাব মেরে ফেলল!’ তিনি আরও জানান, তিনি মামলা করবেন না এবং কোনো বিচার চাইবেন না। এ রকম অনেক বাবা তাঁর প্রিয় সন্তান হারানোর চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন, অনেক সন্তান তার বাবাকে হারিয়ে দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছেন। কক্সবাজারের একরামুল হকের সন্তানদের তাদের বাবার গুলি খেয়ে মরার তীব্র যন্ত্রণা আর গোঙরানি সরাসরি মুঠোফোনে শোনার ঘটনা মনে হলে এখনো আমাদের গা শিউরে ওঠে।

যখন যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, র‍্যাব তার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে আর বিরোধীদের সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এমনকি বর্তমান সরকারও বিরোধী দলে থাকতে এটিকে (?) সংবিধান পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে।

সন্ত্রাস দমনে সাহসী এবং সফল ভূমিকা রেখে মানুষকে নিরাপত্তা আর স্বস্তি দিয়ে র‍্যাব শুরুতে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সময়ের পরিক্রমায় র‍্যাবের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। বিশেষ করে, ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে গুলি এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর একটি পা কেটে ফেলা, কক্সবাজারের একরামুল হককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে র‍্যাব সরকারের আস্থাভাজন বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে আর জনগণের সঙ্গে এই এলিট বাহিনীর দূরত্ব বাড়তে থাকে। যখন যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, র‍্যাব তার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে আর বিরোধীদের সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এমনকি বর্তমান সরকারও বিরোধী দলে থাকতে এটিকে (?) সংবিধান পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে।

বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাগরিক সমাজ, দেশি ও বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা কিংবা আইন-বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। কারণ, এটি আইনের শাসনের মূল ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এবং বাংলাদেশ সংবিধানের মানবাধিকার-সংক্রান্ত ধারাগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দুর্ভাগ্যবশত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর এবং উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বরং মহান সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিক সংসদ সদস্যকে ক্রসফায়ারের পক্ষে কথা বলতে শোনা গেছে, যা দেশে চলমান ক্রসফায়ারকে উৎসাহিত করতে এবং হত্যাকাণ্ডের দায়মুক্তি প্রদানে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে। অপরাধী যত বড় ও ঘৃণ্য অপরাধই করুক না কেন, বাংলাদেশের সংবিধান তাকে আইনের আশ্রয় কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বিশেষত, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মোকাবিলায় গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাব এবং এই বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের মাত্রা বিবেচনায় এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন ছিল। এ ধরনের ঘটনা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের শাসনের মৌলিক নীতিগুলোর স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী।

আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন, যেমন ২০০০ সালে বাংলাদেশ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) অনুস্বাক্ষর করে, যেখানে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা, এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এবং তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ ছাড়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হোক বা না হোক, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করার জন্য রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছে এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারের মনে আশা জাগিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পর গত পাঁচ মাসে দুই–একটি ছাড়া জানা মতে, দেশে কোথাও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। যা থেকে স্পষ্ট হয়, এই নিষেধাজ্ঞা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

যত দিন না সমাজে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সুবিচার নিশ্চিত হচ্ছে, যত দিন না সমাজের অলিগলিতে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য, অসমতা, অন্যায়, অন্ধকার লুকিয়ে আছে তা দূর হচ্ছে, তত দিন ক্রসফায়ার দিয়ে বা বন্দুকযুদ্ধ করে অপরাধ বন্ধ করা যাবে না।

এই নিষেধাজ্ঞা সরকারকে একধরনের অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে, সেটি তাদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট। সরকারের বিদেশ কূটনীতির মূলে এখন এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। শুধু কূটনৈতিক চ্যানেল নয়, সরকার যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে আইনবিদ নিয়োগ করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এটি প্রত্যাহারে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের শরণাপন্ন হতেও দ্বিধা করেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এখন এত আদাজল খেয়ে লাগল, তাহলে এত দিন কেন এত নির্বিকার থেকেছে? এই নিষেধাজ্ঞা কি এতটা অপ্রত্যাশিত ছিল?

র‍্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা র‍্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে আসছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনার পর যুক্তরাজ্য সরকার র‍্যাব সদস্যদের জন্য তার সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ প্রত্যাহার করে নেয়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও তার সহযোগিতা কমিয়ে আনে। এসব নিয়ে সরকার গুরুত্ব দেয়নি বরং বারবার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে গেছে। ফলে দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য ঘটনার মাত্রা আরও বেড়েছে।

বরাবরের মতোই সরকার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে এটি প্রত্যাহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং র‍্যাবের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে, মানবাধিকার রক্ষায় তাদের অঙ্গীকার সমুন্নত হবে এবং এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যথায়, এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হলে কিংবা এর পরিধি বিস্তৃত হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে, দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা এ দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে না।

শেষ কথা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে অপরাধীর জীবন কেড়ে নিয়ে কখনো অপরাধ নির্মূল করা যায় না, বরং রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। অপরাধী নয়, রাষ্ট্রের উচিত অপরাধ দমনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। সে জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার—রাষ্ট্রের আলোকায়ন। যত দিন না রাষ্ট্র এটি পারছে, যত দিন না সমাজে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সুবিচার নিশ্চিত হচ্ছে, যত দিন না সমাজের অলিগলিতে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য, অসমতা, অন্যায়, অন্ধকার লুকিয়ে আছে তা দূর হচ্ছে, তত দিন ক্রসফায়ার দিয়ে বা বন্দুকযুদ্ধ করে অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধের এই ‘সাজানো গল্প’, এই নির্মম অমানবিকতা বন্ধ হোক।

ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: faridecoru@yahoo.co.uk