টেলিভিশনে একটি চায়ের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। বিজ্ঞাপনের গল্পটিতে ভাবনার খোরাক আছে। ভাবনার মূল একটি প্রধান পুরুষ চরিত্রের মুখের সংলাপ। উড়োজাহাজের যাত্রীসেবায় নিয়োজিত একজন প্রমীলা চাকরিজীবীকে যাত্রী চরিত্রটি হুমকির স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি জানো, আমি কে?’ দর্শকেরা বুঝলাম, এটি হুমকি-ধমকি। ভয় দেখানো। অপরজনকে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করার উদ্যোগ। যাত্রী চরিত্রটির পোশাক-আশাক, দেহভাষা এবং ‘জানো আমি কে’ সংলাপে স্পষ্ট যে সে ক্ষমতাধর মানুষ। শুধু ক্ষমতাধরই নয়, ক্ষমতার গরমাগরমি ও ভয়ভীতি দেখানেওয়ালা মানুষ। অনিয়মের মানুষ। সব জায়গায় সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মানুষ। ধরাকে সরা জ্ঞান করা মানুষ। সে অন্যায্য সুবিধাভোগী শ্রেণির একজনই শুধু নয়, নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়াকে তার প্রাপ্য বা অধিকার জ্ঞান করে।
বিজ্ঞাপনের গল্পের মধ্যেও এ রকম চরিত্র চিত্রণ চলে আসার একটি সরল তাৎপর্য আছে। তাৎপর্যটি হচ্ছে এই যে সমাজে ‘তুমি জানো আমি কে?’ সংলাপ অনায়াসে ছুড়ে দিতে পারা মানুষের একটি বড়সড় বর্গ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। দর্শকেরা এই সংলাপের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতার সহজ সংযোগ দেখতে পাবেন, এমন বিশ্বাসের জোরেই নির্মাতা ও গল্পকার সংলাপটি ব্যবহার এবং চরিত্রটি রূপায়ণ করেছেন। বিজ্ঞাপন থেকেও স্পষ্ট যে বাংলাদেশের আমজনতার বড় অংশ সত্যি সত্যিই এ রকম চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত। এক কথায়, চরিত্রটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়া মস্তানতন্ত্রের প্রতিভূ।
প্রতিদিনের দেখা আমাদের আশপাশে হরহামেশা অতিপরিচিত চরিত্র সেটি।
আমি নিজেও এ রকম মানুষ এবং পরিস্থিতি অসংখ্যবার দেখেছি। একবার বাসে ভ্রমণকালে সামনের আসনের একজন যাত্রীর টেলিফোন আলাপচারিতা শুনছিলাম। বাসের সব যাত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ উচ্চ স্বরে যথেষ্ট ডাঁট দেখিয়েই তিনি টেলিফোনের অপর প্রান্তের মানুষটিকে ধমকাচ্ছিলেন, ‘জানো আমি কে?’ আরেকবার ব্যাংকে বিদেশ গমনসংক্রান্ত টাকাপয়সা জমা দেওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়ানো জনাকুড়ি মানুষকে ডিঙিয়ে ধূমকেতুর মতো উদয় হওয়া একজন চলে গেলেন কাউন্টারে। ক্যাশিয়ার বেচারা তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে অনুরোধ করে ধমক খেলেন, ‘জানেন আমি কে?’ ক্যাশিয়ার নিয়ম ভেঙে তাঁর কাজটি দ্রুত করে দিতে বাধ্য হলেন। লাইনে দাঁড়ানো গলদঘর্ম লোকজন খানিকটা আপত্তি ও প্রতিবাদ জানালেও জোর গলায় বাধা দিতে গেলেন না। সবারই ভয়, কে জানে কোথাকার বাঘ না ভালুক! কী হতে কী করে বসবে কে জানে?
দুই.
টেলিভিশনে নিত্যপ্রচারিত বিজ্ঞাপনটির পরিণতি চায়ের গুণগানে। চা পানের পর ক্রেতাসেবার নারীটি সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ফলানো লোকটি ঢিল ছুড়েছে, তাকেও ক্রেতাসেবায় নিয়োজিত নারীটি পাটকেল খাইয়ে দিয়েছে। বাস্তবে তেমনটি হওয়া অসম্ভব। কারণ, প্রথমত এসব আচরণের পেছনে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আশকারা থাকে। ধরাকে সরা জ্ঞান করতে পারার মতো কারণ থাকে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা ফলানোর সংস্কৃতি ডালে-পাতায় সাধারণ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সরাসরি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট নন, তাঁরাও রাজনৈতিক মহলের সমর্থনের দোহাই দেন। পত্রিকায় খবর হয়েছে, ১০ মাসেও চেকবই না পেয়ে এক গ্রাহক ব্যাংক ব্যবস্থাপকের কাছে উষ্মা বা ক্ষোভ জানালে ব্যাংক ব্যবস্থাপক গ্রাহককে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন? আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লোক’।
গড়পড়তা বেশির ভাগ ‘জানো, আমি কে’ ধরনের অন্যায্য ও অন্যায় গর্জনের পেছনের মূল ইঞ্জিন ‘ক্ষমতা-সম্পর্ক’ ও ‘ক্ষমতাসীন রাজনীতি’। কয়েক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এক দুর্বল স্বাস্থ্যের রিকশাচালক একজন নারীনেত্রীর নির্মম শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। জোরে রিকশা চালাতে না পারার কারণে রিকশাচালককে চড়-লাথিতে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। ক্ষমতার বিকার এমনই। খুলনায় টোল প্লাজায় টোল চাওয়ায় রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতার স্ত্রী পুলিশকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। পেছনে সেই একই মনোভাব, ‘তুমি জানো আমি কে?’
একটি সময় ছিল, যখন জনগণ পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের প্রতি কিছুটা আস্থাও রাখত। সেই দিন আর নেই। পুলিশে তো বটেই, প্রশাসনেও ‘তুমি জানো আমি কে’ মনোভঙ্গির ছড়াছড়ি? ‘আমাকে চেনেন?’ ধামকির ভয়ে সরকারি কর্মকর্তার অপেক্ষায় ফেরি ছাড়তে দেরি হয়। অ্যাম্বুলেন্সে মৃতপ্রায় কিশোরের জরুরি চিকিৎসার তাৎক্ষণিক দরকারটি বিবেচনায় নিয়েও ফেরি ছাড়ার নির্দেশ দিতে সাহস করেনি ফেরি কর্তৃপক্ষ। মৃত্যু হয়েছিল কিশোর রোগীর। ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন না করে ভাই বা আপা সম্বোধন করায় স্থানীয় প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তার হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে মানুষকে। তার পেছনেও সেই প্রচ্ছন্ন হুংকার, ‘জানো না আমি কে?’
তিন.
সভ্য দেশে ‘বুলিং’ ও ‘ইন্টিমিডেশন’ অপরাধ। শব্দ দুটির বাংলা অর্থ হতে পারে যথাক্রমে ‘হুমকি-ধমকি বা ভয়ভীতি প্রদর্শন’ এবং ‘ভীতিকর উপায়ে দমিয়ে রাখা’। সভ্য সমাজে দুটিই অপরাধ এবং আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। বাংলাদেশে দুটিই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পেছনের কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতাদর্পিতা ও সংশ্লিষ্ট মস্তানিতন্ত্র। ১৮৬০ সালের প্যানাল কোড, যা এখনো স্বাধীন বাংলাদেশের আইনে আত্তীকৃত আছে সেটি অনুযায়ী, ‘হুমকি-ধমকি বা ভয়ভীতি প্রদর্শন’ এবং ‘ভীতিকর উপায়ে দমিয়ে রাখা’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনটির ধারা-উপধারাগুলো একান্তই ব্যক্তিগত পর্যায়ে একজনের দ্বারা অন্যজনের ক্ষতিগ্রস্ততার প্রতিবিধানে কার্যকর। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশের বেলায় ‘বুলিং’ ও ‘ইন্টিমিডেশন’ ব্যক্তিগত ক্ষতির চাইতে অনেক বেশি বড়সড় ক্ষতি, যা একটি সামাজিক সমস্যার রূপ নিচ্ছে। সমস্যা দুটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতনের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘বুলিং’ ও ‘ইন্টিমিডেশন’ নিয়ে যেসব কর্মযজ্ঞ চলছে, সেগুলোর বৃহদাংশই বিদ্যালয়গামী শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্য করা। প্রয়োগের ক্ষেত্রও মাত্র দুটি। বিদ্যালয় ও ইন্টারনেট। নীতিনির্ধারক ও এনজিওদের ভাবনার পরিমণ্ডল দখল করে রেখেছে বিদ্যালয় ও ইন্টারনেটভিত্তিক সাইবার বুলিং ও ইন্টিমিডেশন প্রতিরোধের চেষ্টা। এই লক্ষ্যে নানা রকম কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের নিত্যজীবনের বিপন্নতা হয়ে ওঠা বুলিং বিষয়ে কোনো কার্যক্রম নেই। কার্যক্রম থাকা সম্ভবও নয় অবশ্য। কারণ, শর্ষের ভেতরেই ভূত! যেহেতু রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের কাছে বুলিং অন্যদের দমনের মোক্ষম অস্ত্র, তারা এই চর্চা তৃণমূল পর্যন্তই ছড়িয়ে দেবে। সে জন্য রাজনীতিকদের কাছ থেকে সহায়তা মেলার সম্ভাবনা শূন্য।
তাহলে উপায়? উপায় একটিই। সামাজিক প্রত্যাখ্যান গড়ে তোলা। ‘তুমি জানো আমি কে?’ মনোভঙ্গিটি এতই সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে যে সমস্যাটি যেখানেই দৃশ্যমান হবে, সেখানেই নাগরিকের স্বশক্তিতে বলীয়ান প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে। এনজিওদের মাধ্যমে হলেও এই মনোভঙ্গির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রচেতনীকরণ শুরু হওয়া দরকার।
ড. হেলাল মহিউদ্দীন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের সদস্য। mohiuddinh@yahoo.com