মতামত

তিয়াত্তর পেরিয়ে যেখানে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ তিয়াত্তর পেরিয়ে চুয়াত্তরে পা রাখল। বাংলাদেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রাচীনতম। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যে দলটির পথপরিক্রমা শুরু হয়েছিল, আজ তা শেখ হাসিনার হাতে। শুরু হয়েছিল সরকারবিরোধী দল হিসেবে। এখন এটি সরকারি দল। এ সময়ের মধ্যে দেশের চালচিত্র অনেক বদলে গেছে, পাল্টে গেছে মানুষ।

শুরুতে নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পথে পা বাড়ায়। ওই সময় পাকিস্তানব্যাপী আওয়ামী লীগের কিছু সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল। তার নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নামেই পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। তবে তার প্রাণশক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে।

১৯৭১ সালের মার্চে এসে পরিপ্রেক্ষিত আমূল বদলে যায়। জনমনে পাকিস্তান তখন মৃত। ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলনে পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উভয় কমিটির সদস্য এবং ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা যোগ দেন। ওই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। একই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি ‘জাতীয়’ দল বা প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশালে একীভূত হয়। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে সামরিক সরকার পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (পিপিআর) মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত জারি করলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। দলটি এখনো এই নাম বহাল রেখেছে।

শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার কারকুনবাড়ি লেনের একটি তিনতলা বাড়ির একতলায়। বাড়ির মালিক ইয়ার মোহাম্মদ খান। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কোষাধ্যক্ষ। তাঁর বাড়িতে তাঁর টাকায় চলত অফিস। তাঁর মালিকানাধীন সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেফাক ছিল দলের মুখপত্র। তিনি ছিলেন প্রকাশক। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মাওলানা ভাসানীর নাম ছাপা হতো প্রথম পৃষ্ঠায়। দরকার হলো একজন সার্বক্ষণিক সম্পাদকের। ইয়ার মোহাম্মদ খান খুঁজে পেলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। তারপর এ পত্রিকা দৈনিক হলো। মালিকানা পেয়ে গেলেন মানিক মিয়া। আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ইত্তেফাক

এ দেশে গরিব মানুষের জন্য বরাবরই রাজনীতি করে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু দলটি জনসাধারণের মধ্যে প্রবিষ্ট হতে পারেনি। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের ভাষায় আওয়ামী লীগ ছিল পেটি বুর্জোয়াদের দল। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দেখা গেল এ দেশের গরিব মানুষের মন জয় করে নিল আওয়ামী লীগ। দেখা গেল, জন্মের পাঁচ বছর না পেরোতেই এটি হয়ে গেল দেশের সবচেয়ে বড় দল, যার পেছনে জনসমর্থন বেশি। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আওয়ামী লীগ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে মিলে একটি নির্বাচনী জোট করেছিল। নাম ছিল যুক্তফ্রন্ট। ওই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। তারপর মুসলিম লীগ আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

মাওলানা ভাসানী প্রথম আট বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু দলের প্রধান সংগঠক ছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে তিনি হন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক হন। এ পদে তিনি একনাগাড়ে ছিলেন ১৩ বছর। ওই সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের উত্থান পর্ব। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ফর্মুলা হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচি দেন ফেব্রুয়ারি মাসে। মার্চ মাসের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি হন দলের সভাপতি। ছয় দফাকে একটি ফেডারেশনের ছক হিসেবে প্রচার করা হলেও এটি ছিল মূলত একটি কনফেডারেশনের ফর্মুলা। ফেডারেল রাষ্ট্রে প্রদেশগুলো পায় স্বায়ত্তশাসন। কনফেডারেশন হয় একাধিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে। ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানের ভাঙনের বীজ লুকিয়ে ছিল। এটা সব বাঙালি না বুঝলেও বুঝেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে পেল একচেটিয়া জয় এবং সারা পাকিস্তানে পেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এর অর্থ হলো, এখন থেকে বাঙালিরা পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করবে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে সেটি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারাই ভেঙে দিল পাকিস্তান। কিন্তু তা এমনি এমনি নয়। রক্তক্ষয় হলো অনেক। বাঙালি প্রতিরোধ করল। লাখ লাখ প্রাণ গেল। কোটি মানুষ গৃহহীন হলো। তারপর এল স্বপ্নের স্বাধীনতা। এটিও এল আওয়ামী লীগের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন জাতির জনক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।

আওয়ামী লীগ তথা প্রায় সব দলেই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দেখা যায়। তারপরও দেখা যায়, অতীতে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে হাইকমান্ড বলে একটা বিষয় ছিল। এখন আর সেটা নেই। দলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একক নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা ছাড়া দলে আর কোনো নেতা নেই। দলের মধ্যে তাঁর কোনো বিকল্পও নেই। এটা দলের মধ্যে তৈরি করেছে সংহতি, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। তিনি না থাকলে কী হবে?

আওয়ামী লীগের ইতিহাসকে নানাভাবে দেখা যায়। মোটাদাগে বলা যায়, আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন এক রূপ, যখন সরকারে থাকে, তখন অন্য রূপ। ১৯৭১-এর আগে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক সরকার চালিয়েছে প্রায় দুই বছর। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারে এসেছে তিন পর্বে, সব মিলিয়ে ২২ বছর। দলটিকে বিচার করতে হলে দেখতে হবে বিরোধী দল হিসেবে তার ভূমিকা আর সরকার পরিচালনায় তার পারঙ্গমতা। একটি দল যখন বিরোধী শিবিরে থাকে, তখন তার প্রধান অবলম্বন হলো ক্ষোভ, দাবিদাওয়া, আন্দোলন এবং সরকারকে কোণঠাসা করা। দলটি সরকারে গেলে তার চরিত্র পাল্টে যায় বা পাল্টাতে হয়। তখন তাকে হতে হয় ধীরস্থির, ধৈর্যশীল ও পরমতসহিষ্ণু। দলটি সরকারে গেলে তখন দলের লোকেরা সরকার চালালেও তারা সারা দেশেরই পরিচালক। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদ সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। এটি সব সময় হয়ে ওঠে না। আমাদের মতো দেশে দল সরকারে গেলে বিরোধী দলের চরিত্র হারায় না। সব সময় যেন একটা মারমার কাটকাট ভাব।

শুরুতেই যাঁরা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একধরনের ভিশন কাজ করেছিল। তাঁরা সরকার গঠনের অভিপ্রায়েই দল গঠন করেছিলেন। তবে তাঁরা দল আর সরকারের পার্থক্য বুঝতেন। দল চলে দলীয় মতাদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। অন্যদিকে সরকার হলো দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের। আওয়ামী লীগ এ বিষয়টি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন সব একাকার। যিনি সরকার চালান, তিনি দলও চালান। এখানেই অতীতের আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমানের আওয়ামী লীগের একটি বড় পার্থক্য।

আওয়ামী লীগ তথা প্রায় সব দলেই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দেখা যায়। তারপরও দেখা যায়, অতীতে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে হাইকমান্ড বলে একটা বিষয় ছিল। এখন আর সেটা নেই। দলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একক নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা ছাড়া দলে আর কোনো নেতা নেই। দলের মধ্যে তাঁর কোনো বিকল্পও নেই। এটা দলের মধ্যে তৈরি করেছে সংহতি, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। তিনি না থাকলে কী হবে? সে যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ বর্তমান নিয়েই আছে। তৃতীয় পর্বে তারা ক্ষমতায় আছে টানা সাড়ে ১৩ বছর। এটা আরও প্রলম্বিত হবে। ফলে একধরনের ‘স্থিতিশীলতা’ তৈরি হয়েছে। একটি দেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন কিংবা অবনমন, দুটোই নির্ভর করে ধারাবাহিক নেতৃত্বের ওপর।

আওয়ামী লীগকে নিয়ে জন-আলোচনায় তিন রকমের কথা চালু আছে। এক. এই দলের কোনো বিকল্প নেই। এই সরকার আছে বলেই উন্নয়ন হচ্ছে। দুই. এই দল জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। একে সরাতে হবে। তিন. এই দল মন্দের ভালো। এটি গেলে যেটি আসবে, তা আরও খারাপ।

বাংলাদেশ এখন মেগা উন্নয়নের পথে আছে। এ জন্য চলছে প্রচুর আয়োজন, প্রচুর অর্থায়ন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অনেক সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আবার এটা বিপদও ডেকে আনতে পারে। তারপরও বলা যায়, শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়েই দল এবং সরকার চালাচ্ছেন। এখনকার আওয়ামী লীগ সত্যিকার অর্থেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক