মতামত

তিলকে তাল করার নীতিতেই হাঁটছে ইসরায়েল

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি ডায়াগ্রাম দেখিয়ে ইরান পরমাণু বোমা বানানোর কত কাছে চলে গেছে, তা বোঝাচ্ছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর
 ছবি: এএফপি

ইসরায়েল রাষ্ট্রটি যখন গঠিত হয়েছিল, তখন থেকেই ইসরায়েলি নেতাদের তিলকে তাল করার চর্চা চলে আসছে। বিন্দুকে নিজেদের কষ্টকল্পনা ও বাগাড়ম্বর দিয়ে সিন্ধু করে তোলা এবং সেই অতিরঞ্জিত ভাষ্যকে বাস্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলায় দেশটির নেতাদের জুড়ি নেই। ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিন নামক রাষ্ট্রটিকে রাষ্ট্রের মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ক্ষেত্রে এই ভয়ংকর কল্পিত ও বিপজ্জনক গালগল্প তাঁরা উদ্ভাবন করে চলেছেন।

দশকের পর দশক তাঁরা নিজেরা কিছু ‘হুমকি’ উদ্ভাবন করেন এবং সেই উদ্ভাবিত হুমকিকে প্রথমে ‘ভয়ানক হুমকি’ এবং শেষ পর্যন্ত সেটিকে ‘অস্তিত্বের সংকটে ফেলা হুমকিতে’ রূপান্তর করে ফেলেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের যুদ্ধ তৎপরতার ন্যায্যতা আগেভাগে প্রতিষ্ঠা করে রাখেন এবং দখলদারিকেও বৈধতাদানের ভাষ্য তৈরি করেন। এই ভাষ্য দিয়েই তাঁরা ফিলিস্তিনি ও আরবদের ইসরায়েলকে ধ্বংস করার তালে থাকা ঘৃণ্য ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রায়িত করেন।

ইসরায়েল অনেক আগে থেকেই ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের সক্ষমতা ও উদ্দেশ্যকে এমনভাবে বাড়িয়ে বলে আসছে যেন মনে হবে, ইরান গোটা বিশ্বের জন্য নিরাপত্তাহুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইসরায়েলের কোনো অপকর্ম নিয়ে কেউ কোনো সমালোচনা করলে ইসরায়েলের মুখপাত্ররা অথবা তাঁদের সমর্থকেরা তাকে ‘অ্যান্টি-সেমেটিক’ আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জয়লাভ করার এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেওয়ার পর ইসরায়েল তথ্য বিকৃতি, অতিরঞ্জন ও মিথ্যাভিত্তিক প্রোপাগান্ডাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ, তাদের জায়গা কেড়ে নেওয়া, গুলি করে ফিলিস্তিনিদের মেরে ফেলা এবং সুপরিকল্পিতভাবে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিঘ্ন সৃষ্টি করাকে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।

দখল করা পশ্চিম তীরে গত মাসেই ইসরায়েল একটি বড় এলাকাজুড়ে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। এই কাজ শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগেই তারা ফিলিস্তিনের ছয়টি প্রধান মানবাধিকার সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যা দিয়েছে। এই সংগঠনগুলো যে সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, তা আন্তর্জাতিক মহলে প্রমাণ করায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েল ব্যস্ত রেখেছে। গণমাধ্যম সেদিকে নজর রাখায় দখল করা ভূমিতে ইসরায়েলের বসতি গড়ার খবর প্রায় চাপা পড়ে গেছে।

ইসরায়েল অনেক আগে থেকেই ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের সক্ষমতা ও উদ্দেশ্যকে এমনভাবে বাড়িয়ে বলে আসছে যেন মনে হবে, ইরান গোটা বিশ্বের জন্য নিরাপত্তাহুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইসরায়েলের কোনো অপকর্ম নিয়ে কেউ কোনো সমালোচনা করলে ইসরায়েলের মুখপাত্ররা অথবা তাঁদের সমর্থকেরা তাকে ‘অ্যান্টি-সেমেটিক’ আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া এবং পশ্চিম তীরে বসতি গড়া—এই উভয় কাজ যাঁর সিদ্ধান্তে হয়েছে, তিনি ইসরায়েলের যুদ্ধ অধিনায়ক ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন্নি গান্টস ছাড়া আর কেউ নন। তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর নেতৃত্বে ২০১৪ সালে গাজায় নির্মম সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল এবং ৫০০ শিশুসহ ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যার অভিযোগে যিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে আছেন। এই ব্যক্তি হচ্ছেন সেই লোক, যিনি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ‘১ হাজার ৩৬৪ জন সন্ত্রাসী হত্যা করেছি’ বলে গর্বভরে ঘোষণা করেছিলেন।

এমন একজন লোক ফিলিস্তিনিদের প্রতি সুবিচার করবে বলে মনে করা যায়? আদতে এই দখলদার ইসরায়েলের ভূমি দখল করার মতো কোনো যুক্তি আছে কি? গ্রান্টস একা নন, তাঁর বর্তমান নেতা নাফতালি বেনেট এবং সাবেক নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলা যায় বিকারগ্রস্ত।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনেট ২০১৫ সালে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে ইসরায়েল ইস্যুতে সবচেয়ে উদারপন্থী অবস্থানে থাকা নেতা মাহমুদ আব্বাসকে পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং আব্বাসের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো আলোচনা করা উচিত হবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী হয়েও বেনেট একইভাবে আব্বাসকে বর্জন করার ভান ধরে ফিলিস্তিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অচল করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেওয়ার সাজা হিসেবে আব্বাসকে তিনি সর্বোচ্চ মাত্রার শাস্তি দিচ্ছেন বলে ভাবা হচ্ছে।

প্রায় তিন দশক ধরে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ধারাবাহিকভাবে ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টায় থাকা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলে আসছেন, ইরান ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে। ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল কিছুদিন পরপর ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে বলে অভিযোগ করে থাকে।

পশ্চিমা মিত্রদের কাছে নেতানিয়াহু ইরানকে ‘শয়তান ইরান’ হিসেবে চিত্রায়ণ করে এসেছেন। এর আগে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি হিসেবে তিনি পশ্চিমাদের কাছে একইভাবে চিহ্নিত করতেন। সাদ্দাম সরকারকে তিনি এক দানব সরকার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। অনেকটা ইসরায়েলের প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ইরানের ওপর পশ্চিমাদের দিয়ে হামলা চালাতে না পারলেও দেশটির ওপর অবরোধের খড়্গ ঝুলিয়ে রেখেছে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মারওয়ান বিশারা মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক