যুদ্ধাপরাধ

তিন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের শেষ পরিণতি

এরিখ প্রিবকে, রুডলফ হেসে, গোলাম আযম
এরিখ প্রিবকে, রুডলফ হেসে, গোলাম আযম

বাংলাদেশের মানুষের এরিখ প্রিবকের নাম শোনার কথা না। না শুনলে ক্ষতি নেই। প্রিবকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হিটলারের ঘাতক দল এসএস পুলিশ বাহিনীর সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৪৪ সালের ২৪ মার্চ ইতালির রাজধানী রোমের কাছে নাৎসিবিরোধী ৭৫ জন ইহুদিসহ ৩৩৫ জন ইতালীয় যোদ্ধার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ইতালীয় ভাষায় পারদর্শী প্রিবকে ১৯৩৬ সালে হিটলারের গোয়েন্দা সংস্থা গেস্টাপোর হয়ে কাজ করতে ইতালিতে যান। সেখানে দ্রুতই তিনি ইতালির ফ্যাসিস্ট পুলিশের কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। বাস্তবে তিনি হিটলারের হয়ে ইতালিতে কাজ করছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হলে অনেক যুদ্ধাপরাধীর মতো প্রিবকে গোপনে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। সেখানে তিনি নির্ঝঞ্ঝাটে ৪০ বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৯৪ সালে আর্জেন্টাইন পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। পরে প্রিবকেকে ইতালিতে ফেরত আনা হয় এবং বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আদালত তাঁর বয়সের কথা চিন্তা করে তাঁকে প্রচলিত কারাগারে না রেখে বাকি জীবনের জন্য গৃহবন্দী করে রাখার আদেশ দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ইতালিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রিবকে তাঁর অপরাধের জন্য আদালত বা অন্য কারও কাছে কখনো ক্ষমা চাননি।
সেই প্রিবকে ১০০ বছর বয়সে ইতালীয় কারাগারে মারা গেলেন গত বছরের (২০১৩) ১১ অক্টোবর। মৃত্যুর আগে প্রিবকে কারা কর্তৃপক্ষকে বলে যান, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে আর্জেন্টিনায় তাঁর স্ত্রীর পাশে অথবা তাঁর জন্মস্থান বার্লিনের কাছে হেনিংসডর্ফে সমাহিত করা হয়। ইতালীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রিবকের এই অন্তিম ইচ্ছার ব্যাপারে আর্জেন্টিনা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়, তাদের দেশে প্রিবকের মতো একজন ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীকে কবর দেওয়ার সুযোগ নেই। আর্জেন্টাইন সরকারের এই সিদ্ধান্তে সে দেশে বসবাসরত তিন লাখ ইহুদির সংগঠন ‘আর্জেন্টিনা জুইস অ্যাসোসিয়েশন’ এক বিবৃতিতে বলে, ‘এই ঘাতক যে দীর্ঘ ৪০ বছর আর্জেন্টিনায় সব সুযোগ-সুবিধাসহ বসবাস করেছে, সেটাই তো তার বড় পাওনা।’ তারা আরও বলে, ‘কখনো কেউ যেন নাৎসি গণহত্যা অথবা যেকোনো ধরনের গণহত্যাকে না ভোলেন এবং ক্ষমা না করেন।’ জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও প্রিবকের লাশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
সিদ্ধান্ত হয়, রোমের বাইরে রক্ষণশীল ক্যাথলিক গির্জা সেন্ট পিউসের কবরস্থানে হবে প্রিবকের শেষ ঠিকানা। এরিখ প্রিবকের লাশ বহনকারী গাড়িটি গির্জার ফটকে পৌঁছাতেই সেটিকে ঘিরে ধরে কয়েক শ ক্ষুব্ধ নাগরিক। উত্তেজিত জনতা প্রিবকের লাশবাহী গাড়িটির সমানে লাথি মারতে থাকে আর থুতু ছিটাতে থাকে অনবরত। ‘আমাদের এই শহরে এই কসাইয়ের জায়গা হবে না,’ চিৎকার করে বলতে থাকে উত্তেজিত জনতা। লাশ বহনকারী গাড়িটির গায়ে একটি ব্যানার টানানো হয়, যাতে লেখা ছিল: ‘যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ঠাঁই নেই’। পরে পুলিশের সহায়তায় লাশ বহনকারী গাড়িটি রোমের একটি সামরিক বিমানবন্দরের ছাউনিতে নেওয়া হয়। পরে অজ্ঞাত স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
রুডলফ হেস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ডেপুটি আর নাৎসি পার্টির নীতিনির্ধারকদের শীর্ষ পর্যায়ের একজন। পেশাদার সৈনিক। জন্ম মিসরে। হিটলারের কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে ১৯৪১ সালে নিজে একটি যুদ্ধবিমান চালিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে প্রস্তাব নিয়ে সোজা উড়ে গেলেন স্কটল্যান্ডে। নামতেই বন্দী করা হলো হেসকে। নিশ্চয় ব্যাটা হিটলারের গুপ্তচর। চার্চিল অত বোকা নন যে বিশ্বাস করবেন হেসের প্রস্তাবে হিটলার যুদ্ধ বন্ধ করবেন। ১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের মাধ্যমে ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়। জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে বসল হিটলারের নাৎসি পার্টির আর অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল। বিশেষ ব্যবস্থায় একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে রুডলফ হেসকে সেই ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দুই মাস হেসের মামলার শুনানি চলল। ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবরে আদালত হেসকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
হেস শান্তির জন্য চেষ্টা করেছিলেন, তা ট্রাইব্যুনাল আমলে নেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের রাশিয়ান সদস্য মেজর জেনারেল ইওনা সিকিতচেনকো মনে করেন, হেসের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য। তিনি ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। হেসকে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই বার্লিনের নিকটবর্তী স্পান্ডু কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কারাগারটিতে প্রায় সব বন্দীই ছিলেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত। আর এটি ছিল যুদ্ধকালীন চারটি মিত্র শক্তির তত্ত্বাবধানে। ৬০০ কয়েদি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই কারাগারে ১৯৬৬ সালের পর একমাত্র বন্দী ছিলেন রুডলফ হেস। এরই মধ্যে অন্যান্য কয়েদির হয় মৃত্যু হয়েছে অথবা কারাবাসের সাজা শেষে ছাড়া পেয়েছেন। ১৯৮৭ সালের ১৭ আগস্ট হেস কারাগারে আত্মহত্যা করেন। রাতের অন্ধকারে হেসকে গোপনে কবর দেওয়া হয়েছিল। এরপর জার্মান কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ কারাগারটি বুলডোজার দিয়ে ধূলিসাৎ করে দেয়, যাতে পরবর্তীকালে নব্য নাৎসিরা এই কারাগারে হেসের স্মরণে কোনো ধরনের স্মারকস্তম্ভ বা তেমন কিছু নির্মাণ করতে না পারে।
এরিখ প্রিবকে অথবা রুডলফ হেসের প্রসঙ্গটা এই কারণেই উল্লেখ করতে হলো, কারণ সম্প্রতি বাংলাদেশেও গোলাম আযম নামের এক সাজাপ্রাপ্ত ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে তাঁর পরিবারের দু-একজন সদস্য উপস্থিত ছিল। প্রিবকে বা হেস তেমন সৌভাগ্যবান ছিলেন না। গোলাম আযম তাঁর একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ঠিক কিন্তু তিনি বিচারের সময় যত রকমের সুযোগ-সুবিধা ও আইনের আশ্রয় পেয়েছেন, তার কোনোটাই প্রিবকে অথবা হেসের ভাগ্যে জোটেনি।
এই তিনজন অপরাধীর মধ্যে এক জায়গায় মিল আছে আর তা হচ্ছে, তাঁরা কেউ কখনো তাঁদের কৃত অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাননি। জামায়াতের এককালের নেতা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং সেগুলোর প্রতিটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইবু্যনাল আরও বলেছেন, গোলাম আযমের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য কিন্তু বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। অথচ তাঁর জানাজার আগে তাঁর ছেলে সবার সামনে বলেন, তাঁর বাবাকে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বাবা যেমন তাঁর অপকর্মের জন্য কখনো দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাননি, তাঁর সন্তানও রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁর বাবার পক্ষে ক্ষমা না চেয়ে বরং একধরনের ক্ষমার অযোগ্য ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন। অথচ একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোলাম আযম ও তাঁর দল শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তাই প্রদান করেনি বরং নিরপরাধ মানুষ মারার কাজে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত ছিলেন।
শুধু গোলাম আযমের ছেলে নন, তাঁর বিচার ও রায় নিয়ে তাঁর কৌঁসুলিরা কয়েক দিন ধরে জনগণকে অবিরাম অসত্য তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রিবকের মরদেহ এখনো দাফনের অপেক্ষায়। হেসকে গোপনে কবর দিতে হয়েছিল। আর লাখ লাখ বাঙালির রক্তে হাত রঞ্জিত গোলাম আযমের শেষকৃত্য বেশ ঘটা করেই অনুষ্ঠিত হলো গত শনিবার বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। জানাজায় অংশ নিয়েছিল তাঁর কয়েক হাজার অনুসারী (জামায়াতের মতে লক্ষাধিক)। জাতীয় মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিলেন মাত্র কয়েকজন তরুণ, এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। এই সবই জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করেছে।
অনেকের প্রশ্ন, কেমন করে ঘটল এমন অভাবিত ঘটনা? এর উত্তরে শুধু বলা যায়, ৪৩ বছরে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় আর প্রশ্রয়ে পাকিস্তানি ধ্যানধারণার মানুষ বাংলাদেশে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। আমার এক গুরুজন আছেন। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১০ কোটি। অবাক হয়ে তাঁর কাছে জানতে চাই, বাকিদের কী হলো? তার সহজ উত্তর, ‘আরে বোকা, ওই বাকিরা তো পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।’ গোলাম আযমকাণ্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কিছু শিখবে, তেমন একটা আশা করি না। সহকর্মী ড. মুনতাসীর মামুনের বক্তব্য দিয়েই শেষ করি। তিনি প্রায়ই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছিলেন।’ তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশের গোলাম আযমের শান্তিতে মরণ ও লাখো শহীদের রক্তবিধৌত এই বাংলার মাটিতে তাঁর শেষ কৃত্যানুষ্ঠান আর তাঁর দাফন। ৩০ লাখ শহীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়া আর কী করতে পারি?
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।