ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলেছিল ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত—২০ বছর। আফগান যুদ্ধ শুরু হয়েছে ২০০১ সালে এবং এখনো চলছে। এ হিসাবে আফগান যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। প্রশ্ন উঠেছে, উভয় যুদ্ধের পরিণতি কি একই হতে যাচ্ছে?
সরকারি হিসাবে আফগান যুদ্ধে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর প্রায় ৪ হাজার এবং আফগান সরকারি বাহিনীর সৈন্য নিহত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। বেসামরিক মানুষের মৃত্যু কয়েক লাখ; শুধু গত বছরই ১০ হাজার। কিন্তু এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ওয়াশিংটন নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান পুনর্বাসনবিষয়ক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল কার্যালয় (এসআইজিএআর) বলছে, দেশটির ৫৯টি জেলা তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, আংশিক নিয়ন্ত্রণ ১১৯ জেলায়। বিবিসির এক জরিপ অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ৭০ ভাগ জেলা নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান।
এক শক্তিশালী ছায়া সরকার
১৬ বছর হলো ন্যাটো বাহিনীর হামলার মুখে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে তালেবান। কিন্তু তালেবান পরাস্ত হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এর জন্য দায়ী মূলত পাকিস্তানের ‘অসহযোগিতা’। ভূরাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারেরা ইরান ও রাশিয়ার গোপন ইন্ধনের কথাও বলেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ওডিআই (ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট) বলছে, আফগানিস্তানজুড়ে একধরনের বিকল্প সরকার ধরে রাখতে পারাই তালেবানের মুখ্য কৃতিত্ব। তালেবান শুধু বন্দুক শাসন করছে না, ন্যাটোর নিয়মিত বোমাবর্ষণের মধ্যেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বিচারব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রতিটি প্রদেশে তাদের সামরিক কমান্ডারের পাশাপাশি পৃথক একজন ছায়া গভর্নরও আছে। তাদের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-সংগঠকদের জন্য ২০০৬ থেকে ‘লেহা’ (আচরণবিধি) আছে, এর দ্বারা তারা বিকল্প এক শাসন-সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। তারা অধিকাংশ প্রদেশে স্থানীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথ কাজের সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছে। তাদের প্রায় ৫০০ বিচারক কাজ করছেন। তালেবান ছায়া সরকার প্রায় ৩০টি সাহায্য সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে নিয়েছে। বেসরকারি টেলিফোন কোম্পানিগুলো এই ছায়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। দর-কষাকষির কাজটি হচ্ছে দুবাইয়ে। খনি থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য পর্যন্ত করারোপের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহের মতো নাগরিক কার্যক্রম বিশাল এলাকায় তাদের জিম্মাতেই হচ্ছে। প্রয়োজনে তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিও করছে। আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে তালেবান কম দুর্নীতিগ্রস্ত বলেই সাধারণ আফগানদের অভিজ্ঞতা। তালেবানের প্রভাব কেবল শরিয়া আইনের রূঢ় কঠোরতার ওপর দাঁড়িয়ে নেই।
সফলতা কেবল যুদ্ধের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই
একসময় ধারণা করা হতো, মোল্লা মোহাম্মদ ওমর মারা যাওয়ার পর তালেবান উপদলে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু ওমরের মৃত্যু এবং পরবর্তী ‘আমির’ মোল্লা আখতার মনসুরকে ২০১৬ সালের মে মাসে হত্যার পরও বাহিনীটির সংহতি টুটে যায়নি। বরং ক্রমে তা একটা বাহিনীর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে উঠেছে। যেকোনো ধরনের শান্তি আলোচনার অংশ হিসেবে অস্ত্রসমর্পণ করলেও তালেবান তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম। ফলে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কোনো সুফল অর্জিত হয়নি, সেটা স্পষ্ট। অনেকটা এই বাস্তবতার স্বীকৃতি হিসেবে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি শর্তহীন শান্তি আলোচনায় ডেকে যাচ্ছেন তালেবানকে। কিন্তু তালেবান চাইছে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলতে।
গত এপ্রিল থেকে তালেবান বসন্তকালীন অভিযানে নেমেছে। তবে তাদের সফলতা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। কূটনৈতিকভাবেও তালেবানকে সামান্যই কোণঠাসা করা গেছে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সঙ্গে অতীত যোগাযোগের সীমিত পরিসর ভেঙে রাশিয়া, ইরান ও চীনের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ এখন খোলামেলা এবং অনেক গভীর। আশরাফ ঘানির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারকে কূটনৈতিক ফ্রন্টে অনেকÿ ক্ষেত্রেই কাতারের তালেবান অফিস কোণঠাসা করে রাখছে।
তালেবানের প্রতি রাশিয়া ও চীনের মনোভাব ২০১৭ সালের শুরু থেকে খুবই নমনীয়। রাশিয়া এরূপ যোগাযোগের কথা প্রকাশ্যেই স্বীকার করে। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচির স্বার্থে আফগানিস্তান সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে। দেশটির খনিজ সম্পদের প্রতিও তাদের বিশেষ আগ্রহ। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরান-তালেবান সম্পর্কের উন্নতি।
ইরান বরাবর আফগানিস্তানে শিয়া হাজারাদের অভিভাবক। সেই সূত্রে পশতুপ্রধান সুন্নি তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল বরাবরই বৈরী। কিন্তু এখন তারা সামনে তাকাতে শুরু করেছে, যা একদিকে আফগানিস্তানে পশতু-হাজারা সংঘাত কমাবে এবং সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে যাবে।
দৃশ্যপটে রহস্যময় আইএসের আগমন
দেশে-বিদেশে তালেবানের নজরকাড়া
‘সফলতা’র মধ্যে সম্প্রতি আফগান পরিস্থিতিতে
নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে আইএসের আবির্ভাব। আফগানিস্তানে শিকড় বিস্তারে আইএসকে কারা সহযোগিতা করছে, সেটা এক বড় গোলকধাঁধা। ২০১৪ থেকে পাকিস্তানসংলগ্ন নানগাহার প্রদেশে কার্যক্রম শুরু করে। এ মুহূর্তে অন্তত ৩০টি জেলায় আইএস সক্রিয়। সিরিয়া ও ইরাক ছাড়তে বাধ্য
হওয়া অনেক যোদ্ধাও আফগানিস্তানকে নতুন কর্মক্ষেত্র হিসেবে নিয়েছে। ন্যাটো কর্মকর্তাদের অনুমান, প্রায় এক হাজার আইএস যোদ্ধা এখন আফগানিস্তানে সক্রিয়।
ফলে তালেবান বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জে পড়েছে। আইএসকে মোকাবিলা এবং তরুণদের কাছে নিজেদের ন্যাটোবিরোধী প্রধান শক্তি প্রমাণ করতে সামরিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হচ্ছে তালেবানকে। এ ক্ষেত্রে ইরান-চীন-রাশিয়া তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে। এই তিন দেশ নিজ নিজ স্বার্থেই আইএসের বিরুদ্ধে। রাশিয়ার সন্দেহ, মধ্য এশিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে এটা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রকল্প। আফগানিস্তানে আইএস যোদ্ধা দলে উজবেকদের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।
ইরানের উদ্বেগ আরও তীব্র। সিরিয়া ও ইরাকে তারা সরাসরি আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। আফগানিস্তানে আইএস কার্যক্রম চালাচ্ছে ‘ইসলামিক স্টেট-খোরাসান’ নামে। স্বভাবত নিজের ভূমিকে জড়িয়ে আইএসের আত্মপ্রকাশের ঘোষণায় তেহরান উদ্বিগ্ন। আইএস প্রভাবিত আফগান জেলাগুলোর কয়েকটি ইরান সীমান্তবর্তী। আইএসের অন্যতম নিয়মিত শিকার শিয়া হাজারারা, যাদের রক্ষায় ইরানের দায় রয়েছে। প্রচুর হাজারা ইরানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করছে। এ রকম বাস্তবতাকে রাশিয়া ও ইরান আইএসকে মোকাবিলায় তালিবানদের সহযোগিতা করতে উৎসাহী।
রাশিয়ার সহযোগিতা তালেবানের জন্য
বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের
সঙ্গে দর-কষাকষিতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। পাকিস্তানে ড্রোন আক্রমণ এড়াতে তারা রাশিয়ার সীমান্তকেও প্রয়োজনে ব্যবহার করতে
পারছে এখন।
রাশিয়াও অন্তত দুভাবে লাভবান। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা অবস্থায় রাখতে পারা তার জন্য মানসিক তৃপ্তির বিষয়। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট মুজাহিদিনদের হাতে আফগানিস্তানে পরাজয়ের খানিকটা প্রতিশোধ নিতে চায় তারা। এ ছাড়া উজবেকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার মুসলমান স্বাধীনতাকামীদের আফগানিস্তানে নিরাপদ
আবাসন বন্ধ করতে তালেবানের সহযোগিতা রাশিয়ার জন্য বিশেষ স্বস্তির। কাশগরের দিক থেকে আসা উইঘুর গেরিলাদের আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকার বিষয়ে চীনও অনুরূপ সহযোগিতা চাইছে তালেবানের কাছ থেকে।
উপরন্তু চীন মনে করছে, তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমঝোতা মাঠপর্যায়ের সামরিক পরিস্থিতির কারণেই অনিবার্য। এ থেকে চীনের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে কূটনৈতিকভাবে চীন এগিয়ে থাকতে চাইছে এখন থেকেই। আফগান সরকার ও তালেবানকে শান্তি আলোচনায় বসাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে সক্রিয় আন্তর্জাতিক শক্তি হলো চীন। মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত তালেবানের নতুন ‘আমির’ হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা দায়িত্ব নেওয়ার (২৫ মে ২০১৬) পর থেকে কাতারের তালেবান অফিসের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। তবে আফগানিস্তানে চীনের আরও সফলতার জন্য প্রয়োজন ১৬ বছরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পিছিয়ে আসার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কোনো পথ খুঁজে পেতে তাকে সাহায্য করা। এখনো সেই সফলতা পায়নি চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান ত্রয়ী। তাদের তেমন ইচ্ছা রয়েছে কি না, সে-ও অনিশ্চিত! যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আফগানিস্তান একটা খারাপ বার্তা দিচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক