ঈদ এলে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান কিংবা গরু নিয়ে আসা ফিরতি ট্রাকে চেপে মহানগর ঢাকা থেকে মানুষেরা যাঁর যাঁর বাড়ির দিকে ধাবিত হন। হাতেগোনা দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতি ঈদে মানুষের এই ভোগান্তিই যেন অনিবার্য নিয়তি। তবে এবার ঈদের আগে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের মানুষেরা ফেরিঘাটের চিরচেনা দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সদরঘাট থেকে লঞ্চভর্তি মানুষ নিয়ে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার ছবিও যেন অতীতের বিষয় হয়ে গেল। যানবাহনের সংকট থাকলেও সড়কপথে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটের যাত্রীরাও অনেকটাই স্বস্তিতে বাড়িতে যেতে পেরেছেন। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের ভোগান্তি আর দুর্ভোগ এবার অবর্ণনীয়। বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, সেই সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হয়েছে মানুষকে। মহাসড়কে ধীরগতি, বাসের সংকটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা আর যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায়—সবকিছুই হয়েছে। গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, নিম্ন আয়ের মানুষেরা এই অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের সবচেয়ে বড় শিকার হন। বাস না পেয়ে গরু নিয়ে আসা ফিরতি ট্রাকে চাপাচাপি করে তাঁরা রওনা দিতে বাধ্য হন।
বরাবরের মতো ট্রেন এবারও অব্যবস্থাপনার ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত হয়েই রইল। আগাম টিকিট কাটা থেকে শুরু হওয়া ভোগান্তি মহাভোগান্তিতে পরিণত হলো শিডিউল বিপর্যয়ে। টিকিট কাটা তো এক যুদ্ধজয়। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ নারী-শিশু-সন্তানসহ ট্রেনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। ট্রেন এলেও ভিড় ঠেলে তাতে ওঠা যাবে কি না, সেই নিশ্চয়তা ছিল না। টিকিট কেটে ট্রেনে উঠতে না পেরে তাই অনেককেই ফিরে আসতে হয়েছে। আবার যাত্রীর চাপে স্টেশনেও অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ট্রেন না ছাড়ায় গরমে ঘামে সেদ্ধ হতে হতে সবার একেবারে প্রাণান্তকর অবস্থা। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ট্রেনের একটি কামরায় গাদাগাদি ভিড়ের মাঝে দম নিতে ছটফট করতে করতে একজন বলছেন, তিনি যদি মারা যান, তাহলে তাঁর পকেটে থাকা আইডেনটিটি কার্ড থেকে যেন তাঁকে শনাক্ত করা হয়। ট্রেনের ছাদে, ইঞ্জিনেও ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই।
এ মহানগরে যেখানে তাঁদের আত্মিক যোগটাই তৈরি হয়নি, সেখানে কীভাবে উৎসব হবে? ঈদ এলেই কিংবা অন্য কোনো পার্বণে তাই মহানগর থেকে পাগলের মতো মানুষ ছুটতে থাকেন যাঁর যাঁর নিজস্ব ঠিকানায়। কিন্তু তাঁরা যাতে একটু স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারেন, একটু সময় নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন, সেই সুযোগটা করে দেওয়া কি খুব কঠিন? তিন দিনের ছুটির ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত? যে সীমাহীন ভোগান্তি আর দুর্ভোগ মানুষের সঙ্গী হয় তাতে প্রশ্নটা জাগা খুব স্বাভাবিক– ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া কি অপরাধ?
এত কষ্ট, এত দুর্ভোগ—এককথায় জীবনকে বাজি রেখে কেন এই ঈদযাত্রা? কবি আল মাহমুদের কবিতায় ঈদে বাড়ি ফেরার এ বাস্তবতাকে ধরা যায়—‘যেন লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশ কোনো অলৌকিক নিয়মে যূথবদ্ধ হয়েছে’। সত্যিই তো। ঈদের ছুটিতে মহানগর ঢাকা থেকে একযোগে লাখ লাখ মানুষ নিজস্ব ঠিকানায় ছোটেন। যানবাহনের যে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা, তার তুলনায় ঘরে ফেরা মানুষের সংখ্যা কত গুণ বেশি? এত মানুষকে উৎসবের আগে এত অল্প সময়ের মধ্য বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়তো অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু পরিকল্পিত অবকাঠামো আর রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে পারলে তা যে সহনীয় রাখা যায়, তার দৃষ্টান্ত তো পদ্মা সেতু থেকেই আমরা দেখতে পেলাম।
ঈদে ঘরে ফেরার এই দৃশ্য দেখে মনে হয়, যেন সবকিছু পেছনে ফেলে যার যার দেশে ফেরার প্রতিযোগিতা। কংক্রিট, পাথর, জঞ্জাল আর প্রাণশূন্য দালান–কোঠার ভিড়ে কেউ কি এ মহানগরকে তাঁর আপন ঠিকানা করে নিতে পারেন? বাসযোগ্যতায় একেবারে শেষের দিকে থাকা ঢাকা মহানগরে এখন প্রায় পৌনে দু্ই কোটি মানুষের বসবাস। চাকরি, ব্যবসা, দোকানদারি, হকারি, দালালি, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা পেটের ধান্দায় এখানে সারা দেশ থেকে মানুষ আসেন, থাকেন। কিন্তু বছরের পর বছর থাকার পরও কারও কি আত্মিক যোগ তৈরি হয় এ নগরীর সঙ্গে? একবার শ্যামলী থেকে মোহাম্মদপুরে যাওয়ার পথে জাপান গার্ডেন সিটির বহুতল একটা ইমারত দেখিয়ে সবিস্ময় এক রিকশাচালক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা মামা, এই যে একেকটা বিল্ডিং, তাতে একেকটা গ্রামের সমান মানুষ, তা–ই না?’
জীবিকার তাগিদে একেক মানুষ এখানে জড়ো হন। বাস্তবে মহানগরে থাকলেও তাঁর চৈতন্যে তিনি পুরোপুরি বাস করেন গড়াই, মাতামুহুরী, ধলেশ্বরী, তিস্তা, সাঙ্গু, ব্রহ্মপুত্র কিংবা অন্য যেকোনো নদীর পাশের গ্রামে, লোকালয়ে। তাই ঈদের আগে গ্রামের পানে ছুটে চলা প্রত্যেক গমনোদ্যত মানুষের মুখাবয়বে, চেহারায় তাঁর ঠিকানা যেন সিলমোহর করে খুদিত থাকে। আল মাহমুদের কবিতায় ফেরা যাক—‘সেখানে নদীর কিনারায় মুদ্রিত একটি করে গ্রাম/ সাধ্যমতো ঘরবাড়ি-গৃহস্থালি রান্নার আগুন আর মরিচের গন্ধ/ বিদ্যুৎহীন আধো অন্ধকারে রাঁধুনির মুখ/ মা কিংবা নিগূঢ় ভালোবাসার প্রগাঢ়ও প্রতিচ্ছবি/ নথ বা নোলক/ তাদের শাড়িতে লোকালয়ের নকশা.../ সেখানে পৌঁছতে হাজার কষ্ট মাড়িয়ে চলে মানুষের মিছিল…’।
আমাদের মতো অবিকশিত গণতন্ত্র এবং প্রান্তীয় পুঁজিবাদি দেশের বড় একটা সমস্যা হলো, সবকিছু্র কেন্দ্রীকরণ। সারা দেশের সম্পদ ও কর্মক্ষম মানুষদের টেনে একটা মহানগর তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশের সম্পদের সঙ্গে গ্লানিও তাই রাজধানীতে এসে জমা হয়। রাজধানীর সঙ্গে মফস্বল আর গ্রামের সম্পর্ক এখনো তাই ঔপনিবেশিক। এর বিপরীতে বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্তটা নেহাত রাজনৈতিক। কিন্তু রাজনীতিকেরা একচ্ছত্র ক্ষমতা বা কেন্দ্রীকরণের বাইরের যেকোনো কিছুকেই হুমকি বলে মনে করেন। ১৮ কোটি মানুষের দেশে সে কারণে এখনো একটা মহানগর। কতটা হাস্যকর, কতটা অযৌক্তিক! বেশি জনসংখ্যা আর কম ভূমির এ দেশে এক ডজন নগর আর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ যখন সমতাভিত্তিক বিকাশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারত, সেখানে আমরা ‘গ্রামকে নগর বানানোর’ আরও একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
৭০০–৮০০ বর্গফুটের একটা বাসা, একটা ঘর, একটা বিছানা, একটা মুঠোফোন কিংবা অফিসের চেয়ারটা তো মানুষের পুরো জীবন নয়। নাগরিক জীবন মানুষের কেজো জীবন। সেটা বাস্তবের জীবনও। কিন্তু এ মহানগরের মানুষদের আরেকটা জীবন, যে জীবন তাঁরা সত্যিকার অর্থে যাপন করতে চান, সেটা পড়ে থাকে একেকটা গ্রামে, একেকটা মফস্বলে।
আবার পরিপূর্ণ নাগরিক জীবন বলতে যা বোঝায়, সে সুযোগই বা কতজন পান? সেই সত্যিকারের সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিক তো হাতেগোনা। অথচ তাদের চারপাশে ভিড় করে থাকা বেনাগরিক, উপনাগরিক কিংবা কিংবা উচ্ছিষ্ট নাগরিকেরাই পুরো উৎপাদনের চাকা টিকিয়ে রাখেন। তাঁদেরও তো উৎসব দরকার, আনন্দ দরকার, জীবনের উদ্যাপন দরকার। কিন্তু এ মহানগরে যেখানে তাঁদের আত্মিক যোগটাই তৈরি হয়নি, সেখানে কীভাবে উৎসব হবে? ঈদ এলেই কিংবা অন্য কোনো পার্বণে তাই মহানগর থেকে পাগলের মতো মানুষ ছুটতে থাকেন যাঁর যাঁর নিজস্ব ঠিকানায়। কিন্তু তাঁরা যাতে একটু স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারেন, একটু সময় নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন, সেই সুযোগটা করে দেওয়া কি খুব কঠিন? তিন দিনের ছুটির ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত? যে সীমাহীন ভোগান্তি আর দুর্ভোগ মানুষের সঙ্গী হয় তাতে প্রশ্নটা জাগা খুব স্বাভাবিক– ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া কি অপরাধ?
প্রতি ঈদে প্রায় ৭০-৭৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়েন। এর অর্থ হচ্ছে, ঢাকার বড় অংশের মানুষ বাড়িতে যেতে পারেন না উৎসব ভাগাভাগি করে নিতে। হাসপাতাল, পুলিশ, সংবাদকর্মীসহ জরুরি সেবার সঙ্গে জড়িত মানুষেরা পেশাগত কারণে থেকে যান। কিন্তু অন্যরা যাতায়াতপথের ভোগান্তি আর অল্প ছুটির কথা চিন্তা করেই যেতে পারেন না। বলা চলে, নিজেদের উৎসবের আনন্দটা তাঁরা উৎসর্গ করেন। কিন্তু তাঁদের মন কি বাড়ির জন্য, স্বজনের জন্য পড়ে থাকে না? আল মাহমুদকে দিয়েই শেষটা করা যাক, ‘সেখানে পৌঁছতে যে পারল না, তার আবার ঈদ, তার আবার বাড়ি?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj. dey@prothomalo.com