বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরের কাছাকাছি। এর মধ্যে মানুষ পাঁচ বছরই কাটায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে—দেড় বছর ফেসবুকে, এক বছর দুই মাস ইউটিউবে, বাকি আড়াই বছর অপরাপর মাধ্যমগুলোতে। আবার যেখানে মানুষ পাঁচ বছর কাটাচ্ছে ওই সব মাধ্যমে, সেখানে কেবল সোয়া এক বছর খরচ করে অফলাইন সামাজিক মেলামেশায়। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এমন নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার নিয়মের মধ্যেও গুরুতর বদল ঘটিয়ে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে প্রথম আলোর জরিপেও কৌতূহলোদ্দীপক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুক এখনো জনপ্রিয়, কিন্তু আগের মতো প্রশ্নহীন নিরঙ্কুশ ভালো লাগা ধীরে ধীরে কমছে। একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক তরুণদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে, অন্যদিকে ভুয়া সংবাদ ও গুজব ছড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় ফেসবুকের ব্যাপারে তরুণ–তরুণীরা সংশয়ী হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি, ইউটিউব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হোয়াটসঅ্যাপের গ্রাফ সামান্য হলেও ওপরে উঠছে।
গুজব আর ভুয়া সংবাদ ফেসবুকের জন্য খুব মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এটি ফেসবুকের কর্তাব্যক্তিরাও বিলক্ষণ জানেন। এ কারণেই ফেসবুক এখন আর কেবলই গ্লোবাল অফিস আকারে নেই। ইতিমধ্যে নানা জায়গায় আঞ্চলিক অফিস খুলছে তারা। তাতেও সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে উঠছে। এখন তারা প্রায় প্রতিটি দেশেই শাখা অফিস খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফেসবুক সাউথ এশিয়ার আয়োজনে কিছুদিন আগে ভারতের দিল্লিতে একটি নিরাপত্তাবিষয়ক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানেও দেখলাম, তাদের মূল দুশ্চিন্তার জায়গা গুজব। গুজব আর ভুয়া সংবাদকে উপলক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নষ্ট হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানাবিধ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়? ফেসবুক এখন এটি নিয়েই বেশি চিন্তিত।
আমাদের শিক্ষিত তরুণ–তরুণীরা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, প্রথম আলোর জরিপ থেকে এমন আভাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গুজব আর ভুয়া সংবাদ বিষয়ে যেসব সচেতনতামূলক কর্মসূচি দেখা যায়, তার বেশির ভাগেরই ভোক্তা স্নাতক পর্যায়ের তরুণ জনগোষ্ঠী। কিন্তু অনতি–তরুণ যারা (১২ থেকে ১৭ বছরের কিশোর), অ্যান্ড্রয়েড ফোনের কল্যাণে তারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় ব্যবহারকারী। জরিপেও সাক্ষ্য মেলে। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এই বয়সগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু এই বয়সগোষ্ঠীকে গুজব আর ভুয়া সংবাদ বিষয়ে সচেতন করার কোনো ভালো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
গুজব আর ভুয়া সংবাদ পৃথিবীতে সব সময়ই ছিল, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এগুলো অন্যমাত্রা অর্জন করেছে। এখন ফেসবুকের কল্যাণে কোনো গুজব যত তাড়াতাড়ি ডালপালা মেলতে পারে এবং যত দূর অবধি উড়াল দিতে পারে, তা অকল্পনীয়। বলা হয়, বর্তমান যুগ সত্য-উত্তর যুগ। এই যুগে সত্যের কোনো বিষয়গত বাস্তবতা নেই; বরং নিজ নিজ মতামত, মতাদর্শ আর মূল্যবোধ দিয়েই মানুষ নিজ নিজ ‘সত্য’ বানিয়ে তোলে। ‘ইকো চেম্বার’ বলে একটা ধারণা চালু আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। এটাকে বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘একমত সংস্কৃতি’। মানুষ যেসব বিষয়ে একমত, যা পছন্দ করে, সে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিবেশে শুধু সেগুলোই দেখবে এবং শুনবে। এই মনস্তত্ত্বের পালে বাতাস দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও তাদের সার্চ ইঞ্জিন এমনভাবে ডিজাইন করেছে, যেন এ মাধ্যম ব্যবহারকারী সব সময় তাঁর পছন্দমতো বা রুচির বাগানে শুয়ে-বসে থাকতে পারেন। বাইরে যা ঘটুক, তাঁর রুচির বাগানই তাঁর কাছে সত্য হয়ে ধরা দেয়। তাঁর হোমপেজ তাঁরই রুচি অনুযায়ী সাজানো। এটাই ইকো চেম্বার, সত্য-উত্তর যুগের। এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে প্রত্যেক মানুষের ইকো চেম্বার তাঁর রুচির বাগান হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত সত্য তৈরি হচ্ছে। গোষ্ঠীগত সত্য তৈরি হচ্ছে। অমুকের সত্যের সঙ্গে তমুকের সত্যের সংঘর্ষ লাগছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে এর পাদানি হিসেবে।
এত দিন এভাবেই চলছিল। আরও কিছুদিন হয়তো চলবেও। এর মধ্যে যাঁরা সচেতন, তাঁরা সতর্ক থাকবেন। কিন্তু খুব বেশি মানুষকে সচেতন করা যায়নি। অনতি–তরুণদের কথা আগেই বললাম। শহরকেন্দ্রগুলোর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে আমাদের গ্রামবাংলায়, তাদের আছে ঘরে ঘরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আর সুলভ ইন্টারনেট সংযোগ। তারাও আছে ফেসবুকে, ইউটিউবে, এমনকি ইনস্টাগ্রামে। শিক্ষাবিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার আগেই যে বিরাট যোগাযোগ-বিপ্লবখানি ঘটে গেল, তাকে প্রশংসা করার সুযোগ পেলাম কই? তার আগেই তো গুজবে সয়লাব হয়ে গেল চারপাশ!
ফেসবুকের পেছনে যে প্রতিষ্ঠান আছে, তার পক্ষে গুজবের এই বিশ্বব্যাপী বিস্তারকে লাগাম পরানো সহজ কাজ নয়। এত এত দেশ, এত এত ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির মধ্যে বেড়ে ওঠা লাখো গুজবের মোকাবিলা কোনো অভিন্ন নিয়ম দিয়ে করা যাবে না। এই দিশেহারা অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে তারা এখন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর শরণ নিচ্ছে। তথ্য বিক্রির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে পৃথিবীর বহু দেশেই ফেসবুক ক্রমে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার সহায়ক শক্তি হয়ে উঠছে। অথচ কথা ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক আমজনতার ক্ষমতায়ন করবে! এই প্রত্যাশা থেকেই মানুষ এহেন যোগাযোগব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরেছিল। এখন এই ব্যবস্থা তার গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফেসবুক কিংবা টুইটার অ্যাকাউন্টের বদৌলতে সংঘহীন ব্যক্তিমানুষ ক্রমে শনাক্তযোগ্য এককে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থার ষোলো আনা সুবিধা নিচ্ছে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলো।
ফলে আশঙ্কা থাকছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে মানুষ ক্রমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য এ মাধ্যম নিয়ে যত বড় গল্পই ফাঁদা হোক, ইন্টারনেটে মানুষের কার্যকলাপের মাত্র ২০ শতাংশ নাকি দখল করে আছে সে! গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি মিলিয়ে মাত্র ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশই ঘটে আরও গভীরে, ডিপ ওয়েব বলা হয় তাকে। এই ওয়েব জগৎ ইন্টারনেটের সাধারণ সন্ধানপ্রক্রিয়ায় লভ্য নয়। কোনো জরিপ দিয়েও তাকে বোঝা মুশকিল। ডিপ ওয়েবের আরও গভীরে এক জগৎ আছে, যাকে ডার্ক ওয়েব বলে ডাকা হয়। ডিজিটাল আন্ডারগ্রাউন্ডও বলেন কেউ কেউ। আন্ডারগ্রাউন্ডের খবর উপরিতলে খুব বেশি আসে না। মাঝেমধ্যে আসে। ব্লু হোয়েল খেলাটির কথা নিশ্চয়ই আমাদের অনেকের মনে পড়বে। খেলার অংশ হিসেবে আত্মহত্যা করতে হতো। ডার্ক ওয়েবে এমন আরও অনেক জিনিস ঘটে। অনেক গুজব আর কেলেঙ্কারির উৎপত্তিও হয় সেখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যদি আরও বেশি খবরদারিমূলক আর রাষ্ট্রবান্ধব হয়ে ওঠে, মানুষ তখন অন্য বিকল্পগুলোর কথা ভাবতে শুরু করবে। ডার্ক ওয়েব একটা বিকল্প। অত্যন্ত ভয়ংকর বিকল্প। সেখানে খবরদারি নেই। কিন্তু বিপদ আছে ভীষণ—ব্যক্তির জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য।
ইন্টারনেট কেবল বিনোদনের জায়গা নয়, জ্ঞান আহরণের জায়গাও। আবার অপরাধ সংঘটনের জায়গা তো বটেই। গবেষণা করতে গিয়ে ক্যাটাগরি–বিভ্রাট ঘটে অনেক সময়। যেমন প্রথম আলোর জরিপ বলছে, প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটান বাংলাদেশের তরুণ–তরুণীরা। টেলিভিশনে সময় দিচ্ছেন তার চেয়ে কম ইত্যাদি। কিন্তু ইন্টারনেট তো একটা সমান্তরাল জগৎ। সে জগতে টেলিভিশন আছে, আড্ডাস্থল আছে, কেনাকাটা আছে, এমনকি খাওয়া পর্যন্ত যায়! ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট টেলিভিশন বা আড্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ক্যাটাগরি আর নয়। আগে হয়তো ছিল। এখন এগুলোকেও সে তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। অনেকে ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই ঝঞ্ঝাটময় জীবন ছেড়েছুড়ে দিয়ে অফলাইন জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করেন। ইন্টারনেট যুগে জন্মানো তরুণ–তরুণীদের পক্ষে এটা ভীষণ কঠিন। তাঁরা তো আমাদের মতো পরিণত বয়সে এসে ইন্টারনেটে দীক্ষা নেননি! এ কারণে আমাদের মাথা থেকে আসা এনজিও-মার্কা কর্মসূচি দিয়ে তাঁদের সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। তাঁদের জায়গা থেকেই বুঝতে হবে ব্যাপারটা।
সুমন রহমান কবি, গল্পকার ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক