রমজান মাসের বিশেষ ইবাদত হলো তারাবিহর নামাজ। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ পড়বে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে (বুখারি, হাদিস: ৩৬)।’
রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রোজার আগেই তারাবিহ নামাজ আদায় করা রমজানের সুন্নাত। এমনকি যাঁরা শরিয়তসম্মত কোনো গ্রহণযোগ্য ওজরের কারণে রোজা পালনে অক্ষম, তাঁরাও সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে তারাবিহ নামাজ পড়বেন। পুরুষদের জন্য তারাবিহর নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নাত। নারীরা বাড়িতে আদায় করবেন। শিশুরাও সামর্থ্যমতো বড়দের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব তারাবিহ পড়বে।
‘তারাবিহ’ অর্থ বিশ্রাম নেওয়া ও প্রশান্তি লাভ করা। এটি ‘তারবিহাহ’ শব্দের বহুবচন। পরিভাষায় ‘রমজান মাসে এশার নামাজের পর আদায় করা সুন্নাত নামাজকে তারাবিহ নামাজ বলে (কামুসুল ফিকহ)।’ এ নামাজে চার রাকাত পরপর বিরতির মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়া হয় বলে এর নাম তারাবিহ। এ নামাজে দেহ-মনে প্রশান্তি আসে বলেই এর নাম তারাবিহ বা প্রশান্তির নামাজ। ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
ইসলামের অন্যতম প্রধান দুটি ইবাদত নামাজ ও রোজা ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার জন্য ফরজে আইন হিসেবে প্রযোজ্য। রোজার সঙ্গে তারাবিহর নামাজের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। রাসুলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবিহ নামাজকে সুন্নাত করেছি। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে দিনে রোজা পালন করবে ও রাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এরূপ পবিত্র হবে, যেরূপ নবজাতক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয় (নাসায়ি, পৃষ্ঠা: ২৩৯)।’
রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। তারাবিহর নামাজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য কোরআন তিলাওয়াত করা ও শোনা। এ নামাজে পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার পাঠ করা সুন্নাত। একে খতম তারাবিহ বলা হয়।
রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রোজার আগেই তারাবিহ নামাজ আদায় করা রমজানের সুন্নাত। এমনকি যাঁরা শরিয়তসম্মত কোনো গ্রহণযোগ্য ওজরের কারণে রোজা পালনে অক্ষম, তাঁরাও সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে তারাবিহ নামাজ পড়বেন
তারাবিহ নামাজে পূর্ণ কোরআন মাজিদ না পড়ে বিভিন্ন সুরা দিয়ে তারাবিহ পড়াকে সুরা তারাবিহ বলা হয়। সুরা তারাবিহ পড়লেও ২০ রাকাত পড়া সুন্নাত। একা পড়লেও ২০ রাকাতই পড়া সুন্নাত। মহিলাদের জন্যও ২০ রাকাত তারাবিহ সুন্নাত। এশার নামাজের পর থেকে ফজরের ওয়াক্তের আগপর্যন্ত তথা সাহ্রির শেষ সময় পর্যন্ত তারাবিহ নামাজ পড়া যায়। একসঙ্গে একই সময় ২০ রাকাত পড়তে না পারলে ভেঙে ভেঙে আলাদাভাবেও পড়া যাবে। যেহেতু এটি সুন্নাত নামাজ, তাই কোনো কারণে পড়তে না পারলে অসুবিধা নেই। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে রোজাদারের উচিত তারাবিহ নামাজ পড়তে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ প্রতিষ্ঠিত নিরবচ্ছিন্ন সুন্নাত। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘তবে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, নিশ্চয় উবাই ইবনে কাআব (রা.) রমজানে রাত জাগরণে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর নামাজ পড়তেন।’ তাই উলামায়ে কিরামের একটি বড় অংশ মনে করে, এটাই সুন্নাত। কেননা, তা আনসার, মুহাজির—সব সাহাবির মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, কেউ তা অস্বীকার করেননি। অন্যান্য ইমাম বিতরসহ তারাবিহ ৩৯ রাকাত পড়া পছন্দ করেন। কারণ, তা হলো মদিনার আমল। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) আরও বলেন, ‘সুতরাং ২০ রাকাত তারাবিহ-ই উত্তম এবং এটাই অধিকাংশ মুসলমানের আমল; আর নিশ্চয় এটি ১০ (সর্বনিম্ন) ও ৪০ (সর্বোচ্চ)-এর মাঝামাঝি। তবে যদি কেউ ৪০ রাকাত বা অন্য কোনো সংখ্যা আদায় করেন, তবে তা-ও জায়েজ হবে। এ বিষয়ে অন্যান্য ইমাম আলোকপাত করেছেন (মজমুআ ফাতাওয়া, খ্ল: ২২, পৃষ্ঠা: ২৭২; খ্ল: ২৩, পৃষ্ঠা: ১১২)।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ পড়তেন; তারপর বিতর নামাজ পড়তেন (মাজমুআ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া, খ্ল: ১১, পৃষ্ঠা: ৩৯৩)।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রুম্মান (রহ.) বলেন, ‘হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতের সময় মানুষ ২৩ রাকাত (বিতরসহ তারাবিহ নামাজ) দ্বারা রাত জাগরণ করত (মুআত্তা ইমাম মালিক, খণ্ড: ১, হাদিস: ২৮১; আবু দাউদ, খণ্ড: ১, হাদিস: ৪২৮৯)।’ মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন, ‘তারাবিহ নামাজ ২০ রাকাত, এ বিষয়ে সব সাহাবির ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছে (মিরকাত শারহে মিশকাত, খ্ল: ৩, পৃষ্ঠা: ১৯৪; মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ২০০-২০১)।’ হজরত হাসান (রা.) বর্ণনা করেন, ‘দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) মানুষকে একত্র করলেন হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.)-এর পেছনে; তখন তিনি তাদের ইমামতি করে ২০ রাকাত নামাজ পড়তেন (আবু দাউদ, খণ্ড: ২, হাদিস: ১৪২৯)।’
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। smusmangonee@gmail.com