চীন মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকাণ্ড জাতিসংঘ সমুদ্র সনদের প্রবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়
চীন মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকাণ্ড জাতিসংঘ সমুদ্র সনদের প্রবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়

তাইওয়ান প্রণালিতে যুক্তরাষ্ট্র কি চীনের সঙ্গে ‘চিকেন গেম’ খেলছে?

গত শুক্রবার মার্কিন নৌবাহিনীর গোয়েন্দা ও নজরদারি বিমান পসাইডন পি-৮ তাইওয়ান প্রণালিতে উড্ডয়ন করে। নিয়মিত উড্ডয়নের অংশ মনে হলেও এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চীনের সঙ্গে চলমান বিতর্কে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এটি সর্বশেষ দাবার চাল। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড দাবি করেছে, এই উড্ডয়ন ‘মুক্ত ও স্বাধীন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি’ তারই প্রদর্শন। তাইওয়ান প্রণালির ‘আন্তর্জাতিক’ আকাশসীমায় উড়েছে বিমানটি। তাইওয়ান প্রণালিসহ যেখানেই আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র বিমান ওড়াবে, জাহাজ চালাবে।

তাইওয়ান প্রণালিতে চীন নিজেদের যে আইনগত এখতিয়ার দাবি করেছে, তার প্রতিক্রিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিমান উড্ডয়ন ও বিবৃতি। পাল্টা বিবৃতিতে চীন জানিয়েছে, ‘তাইওয়ান প্রণালির শান্তি ও নিরাপত্তাকে পদদলিত করার এই ইচ্ছাকৃত কাজের তীব্র বিরোধিতা করে চীন। আমাদের সেনাবাহিনী জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব সময়ই সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, তাইওয়ান প্রণালি আন্তর্জাতিক জলসীমা। এর অর্থ হচ্ছে, তাইওয়ান প্রণালি কোনো রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের এখতিয়ারে না পড়ায় সেখানে মুক্তভাবে নৌচালনা ও সেখানকার আকাশে বিমান উড্ডয়ন করার স্বাধীনতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনেই সেই সুরক্ষা রয়েছে। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাইওয়ান প্রণালিতে ‘চীনের সার্বভৌমত্ব, সার্বভৌম অধিকার ও আইনগত এখতিয়ার রয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট দেশ তাইওয়ান প্রণালিকে আন্তর্জাতিক জলসীমা বলে দাবি করে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি।

যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের বিবৃতি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটা বোঝাতে চায় যে তাইওয়ান চীনের অংশ নয় এবং তাইওয়ান প্রণালির একটি অংশের আইনগত অধিকার ভিন্ন একটি সরকারের, তাহলে তাইওয়ানের ওপর চীনের সার্বভৌম অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, চীন যেহেতু বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের ওপর আইনি অধিকার চর্চা করতে পারে না, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড করছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কে সঠিক? জাতিসংঘ সমুদ্র আইনবিষয়ক সনদে (ইউএনসিএলওএস) ‘আন্তর্জাতিক জলসীমা’ বা ‘আন্তর্জাতিক জলপথ’ উল্লেখ নেই। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সমুদ্র সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। সে জন্য এর বিধিগুলোর সুবিধা দাবি করার মতো আইনই তাদের নেই। তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের আইনগত এখতিয়ারের দাবিটি সঠিক। আন্তর্জাতিক জলসীমার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সৃষ্টি করা একটা ধারণা, যাতে তারা ‘নৌযান চালনার স্বাধীনতা’ পায়।

জাতিসংঘ সমুদ্র সনদ অনুযায়ী, কোনো একটা প্রণালি কাদের অধিকারে থাকবে, তা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ‘ভূখণ্ডগত সমুদ্রসীমা’, ‘সংলগ্ন এলাকা’ ও ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’। একটি রাষ্ট্রের উপকূলীয় ভিত্তিভূমি থেকে কমপক্ষে ১২০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্র অঞ্চল ওই রাষ্ট্রের আওতাধীন। সেখানে তাইওয়ান প্রণালি চীনের মূল ভূখণ্ডের ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে। এ কারণে উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে এ প্রণালির ওপর চীনের সার্বভৌমত্ব থাকবে। আবার এ প্রণালির ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত চীনের সংলগ্ন এলাকা। এ কারণে উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ান প্রণালিতে কোনো আইন ভঙ্গ হচ্ছে কি না, তা রোধ করা ও শাস্তি দেওয়ার অধিকার রয়েছে চীনের। এ ছাড়া রাজস্ব আদায় ও অভিবাসন পরিচালনারও অধিকার রয়েছে দেশটির। আবার এই তাইওয়ান প্রণালি ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি প্রশস্ত নয়। সেখানে উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে সেখানকার সম্পদ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে চীনের। ফলে তাইওয়ান প্রণালির কোনো অংশই রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারমুক্ত এলাকা নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, তাইওয়ান প্রণালিতে বিদেশি যুদ্ধজাহাজের কিংবা যুদ্ধবিমানের মুক্তভাবে চলার অধিকার আছে নাকি নেই। জাতিসংঘ সমুদ্র সনদ অনুযায়ী, তাইওয়ান প্রণালির ভেতর দিয়ে যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের স্বাভাবিক চলাচল বৈধ। কিন্তু যেসব দেশ জাতিসংঘ সমুদ্র সনদে স্বাক্ষর করেনি, তাদের ক্ষেত্রে এ অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে প্রথাগত আইন আবার এ ধরনের যাতায়াতের পথের স্বীকৃতি দেয়। যাহোক জাতিসংঘ সমুদ্র সনদ অনুযায়ী, যাতায়াতের এই পথের সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান কী করছে, সেটার ওপর নির্ভর করে। উপকূলীয় রাষ্ট্রের অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি ‘যথাযথ সম্মান’ প্রদর্শন করার বাধ্যবাধকতা তাদের রয়েছে। পসাইডন পি-৮–এর উদাহরণটি বিবেচনা করা যাক। এটি সাবমেরিন যুদ্ধ, পানির উপরিভাগের যুদ্ধ, গোয়েন্দা, নজরদারি ও শত্রু পরিবেষ্টিত এলাকা পর্যবেক্ষণের উপযোগী যুদ্ধবিমান। টর্পেডো, হারপুন ও জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল সজ্জিত। এ উড়োজাহাজ থেকে ড্রোন চালনা করা যায়।

যদি কোনো যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের সাইবার অথবা ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা থাকে, তবে সেটা হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতিসংঘ সমুদ্র সনদ এ ধরনের হুমকি সৃষ্টিকারী জাহাজ বা বিমানের চলাচলকে স্বীকৃতি দেয় না। প্রকৃতপক্ষে এ রকম কিছু সাইবার ও ইলেকট্রিক হামলা যুক্তরাষ্ট্র যে চালাতে পারে, সে রকম কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, তাতে ‘সাইবার হামলা’কে মিসাইল বা বোমা হামলা বা সরাসরি হামলার সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ সমুদ্র সনদে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা যুদ্ধবিমানের সাইবার কিংবা ইলেকট্রনিক যুদ্ধের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ বলে বিবেচনা করা হয়।

বিশেষ করে যেসব জাহাজ ও বিমান সংকেত গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে জড়িত, সেগুলো সুচিন্তিতভাবেই প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড করে। চীন মনে করে এসব কর্মকাণ্ড জাতিসংঘ সমুদ্র সনদের প্রবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সামুদ্রিক গবেষণার জন্য অবশ্যই উপকূলীয় রাষ্ট্রের সম্মতি নিতে হবে। কিন্তু কোনো যুদ্ধজাহাজ কিংবা যুদ্ধবিমান যদি সেখানে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, এমন কোনো যন্ত্র (যেমন ড্রোন) পরিচালনা করে, তবে সেগুলো এই প্রবিধানের আওতায় পড়বে।

সামরিক ও আইনগত বিষয়কে পেছনে রেখে এখন বিতর্কটা রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাইওয়ানের রাজনৈতিক মর্যাদার বিষয়টিই এখন সামনে চলে আসছে। ‘এক চীন নীতির’ শর্ত অনুযায়ী তাইওয়ান যদি চীনের অংশ হয়, তাহলে পুরো তাইওয়ান প্রণালিই চীনের আইনগত এখতিয়ারে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের বিবৃতি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটা বোঝাতে চায় যে তাইওয়ান চীনের অংশ নয় এবং তাইওয়ান প্রণালির একটি অংশের আইনগত অধিকার ভিন্ন একটি সরকারের, তাহলে তাইওয়ানের ওপর চীনের সার্বভৌম অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, চীন যেহেতু বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের ওপর আইনি অধিকার চর্চা করতে পারে না, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড করছে।

তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই চিকেন গেমে (মুখোমুখি অবস্থানে থেকেও সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া) পরবর্তী পর্ব কী?

মার্ক ভ্যালেন্সিয়া আন্তর্জাতিক সমুদ্র নীতিবিষয়ক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে